জাতীয় সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বাত্মক গণআন্দোলন গড়ে তুলুন

ভাষ্যকার

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
অসম্ভব গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা আর মাত্রাতিরিক্ত তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে অবশেষে গত ১৭ নভেম্বর স্থানীয় একটি পাঁচ তাঁরা হোটেলে ‘ইন্টারিম সরকার’ ডেনমার্কের কোম্পানির সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া টার্মিনাল নিয়ে চুক্তি করেছে। সরকার যেভাবে তের দিনে চুক্তি করছে তা-ও ইতিহাসে বিরল। ২০০৬ সালের অক্টোবরে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর চট্টগ্রামে প্রদত্ত গণসম্বর্ধনায় ড. ইউনূস আবদার করে বলেছিলেন- ‘চট্টগ্রাম বন্দর মুক্ত করে দিন, দেশের চিত্র পাল্টে যাবে।’ সাড়ে আটশত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে অর্জিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের রথে চড়ে ক্ষমতায় বসেও বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দেয়ার সংকল্প থেকে তিনি সরে আসেননি। সরকার চালাকি করে ১৭ নভেম্বর, সকাল ১০টায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এপিএম টার্মিনালসের সাথে চুক্তির তারিখ বেছে নিয়েছিল। কারণ ঐদিনই সকাল ১১টায় শেখ হাসিনার মামলার রায়। শেখ হাসিনার রায়ের ডামাডোলে গোপনে জনগণকে বিভ্রান্ত রেখে চুক্তি সম্পন্ন করাই ছিল তাদের মতলব। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিগণ সরকারের দেশবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। রাজপথে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বন্দরসহ কৌশলগত জাতীয় সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তড়িঘড়ি হস্তান্তরের সকল অপচেষ্টা রুখতে সর্বাত্মক গণআন্দোলনে সামিল হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে হস্তান্তরের চলমান প্রক্রিয়া এবং লালদিয়া চরে টার্মিনালের নকশা প্রণয়ন, নির্মাণ, পরিচালনার জন্য ডাচ কোম্পানির সাথে ইতোমধ্যে সম্পন্ন ৩৩ বছরের কনসেশন চুক্তি ও সুইচ কোম্পানির সাথে সম্পন্ন ঢাকার অদূরে পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল ২২ বছরের পরিচালনা চুক্তি ক্ষমতাসীন সরকারের এখতিয়ার বহির্ভূত। জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে পরিচালিত হয়ে ভিন্ন কারো স্বার্থে যে পদক্ষেপসমূহ সরকার গ্রহণ করছে তা করার কোনো সাংবিধানিক অধিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। বাম গণতান্ত্রিক জোট লালদিয়াসহ চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, জনমত উপেক্ষা করে মূল্যায়ন কমিটিকে পাস কাটিয়ে প্রয়োজনীয় বোর্ড সদস্য ছাড়াই অনুমোদন নিয়ে সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ৭ ও ৮ নভেম্বর ২০২৫ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চুক্তির নেগোসিয়েশন ও চূড়ান্ত দলিল কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদেশিদের হাতে বন্দর ইজারা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। তার উচিত একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়া। দেশের স্বার্থ বিপন্ন করে বিগত সরকার মেগা প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল, যার খেসারত দিতে হচ্ছে জনগণকে। অভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমান সরকার সেই ধারাবাহিতায় দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করে দেশকে একটি সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। লালদিয়া টার্মিনাল চুক্তির মত একইরকম অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া করে নিউমুরিং টার্মিনাল চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অপমান, অপদস্ত করে ড. ইউনূস যেমন প্রবাসী ও দ্বৈত নাগরিকদের দিয়ে সংস্কারের কাজ করাতে চেয়েছেন, তেমনই উন্নয়নের বুলি কপচিয়ে দেশের সম্পদ বিদেশিদের কাছে হস্তান্তর করার পাঁয়তারা করছেন। প্রশ্ন হলো দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এরকম তাড়াহুড়া, অনিয়ম এবং গোপনীয়তার সাথে করতে কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এত ব্যস্ত? গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) সরকারের পরামর্শক হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা ও লালদিয়া টার্মিনালের কনসেশন চুক্তি তৈরিতে কাজ করছে। তাদেরই পরামর্শে পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকার, বর্তমানে ইউনূস সরকার বন্দরের টার্মিনালগুলো বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেবার আয়োজন করছে, তাদেরই পরামর্শে বন্দরে সম্প্রতি ৪১% ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের বরাতে জানা যাচ্ছে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ১০ বছরের জন্য ১০০% করমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে কর্মরত বিদেশি টেকনিক্যাল স্টাফও করমুক্ত সুবিধা পাবেন। এছাড়া কোম্পানিগুলোর রয়্যালটি, টেকনিক্যাল নলেজ ফি, লভ্যাংশ সবকিছুই করের আওতামুক্ত থাকবে। চট্টগ্রামের শ্রমিক-কর্মচারীসহ সর্বস্তরের জনগণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাম জোটসহ দেশপ্রেমিক জনগণ এর বিরুদ্ধে রোডমার্চসহ নানামুখী কর্মসূচি পালন করেছে। তারপরও সরকার তার দেশবিরোধী পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসছে না। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতার শেষ নাই। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের দিতে তার সক্রিয়তা মাত্রাতিরিক্ত। এরকম সরকারের কোনো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধিকার নেই। শেখ হাসিনা সরকারের সময় এসব তৎপরতা শুরু হয়েছিল। সেখানে শত শত কোটি টাকার কমিশন ভোগীরা এই কাজে উদ্যোগী ছিল। বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও এরকম কমিশনভোগীদের তৎপরতা বিদ্যমান থাকায় জনগণ বিস্মিত। চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে হবে স্বচ্ছতার সাথে, বন্দরের মতো কৌশলগত সম্পদ নিয়ে চুক্তির শর্ত প্রকাশ করতে হবে, সর্বজনের সম্মতি লাগবে। জনগণের সম্মতিহীন সরকারকে মানুষ উচ্ছেদ করেছে। জনগণের সম্মতিহীন দেশবিরোধী চুক্তিকারীদেরও উচ্ছেদ সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকারের এখন প্রধান কাজ একটা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। এরজন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নির্বাচনী পরিস্থিতি তৈরি করা এখনকার প্রধান কাজ। আগামী ২৯ নভেম্বর জনগণের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের লক্ষ্যে ‘রাজনৈতিক কনভেনশন’ অনুষ্ঠিত হবে। কনভেনশনে দেশ রক্ষায়, দেশের সম্পদ রক্ষায় ও দেশের মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে প্রণীত হবে ‘জনতার সনদ’। দেশে শুরু হবে নয়া অভিযাত্রা।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..