
একটা নিকষ অন্ধকার সময় পার করছি আমরা। অসম প্রতিযোগিতায় দিন কাটছে। এ সময়কালেও কেউ দিব্যি আছে- বাড়ি বানাচ্ছে, গাড়ি কিনছে আর অধিকসংখ্যক মানুষ দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে কোনোমতে খেয়ে পড়ে আছে। প্রান্তিক মানুষ শুধু অপর্যাপ্ত খেয়ে আছে তা নয়- চরম নিরাপত্তাহীনতায় জীবনযাপন করছে। বিশেষ করে যার ঘরে কন্যাসন্তান রয়েছে, তাদের তো দুশ্চিন্তার শেষ নেই। যে অস্থির সময়ে নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-প্রতিবন্ধীরা বেশি বিপদাপন্ন হন আমরা সেই সময়ে রয়েছি। আজ ছোট্ট লেখায় শুধু নারীর বিপন্নতার কথা এবং কী করে পরিত্রাণ পেতে পারি এমন আশার কথা লিখব।
পুঁজিবাদের চক্করে হৃষ্টপুষ্ঠ হয়ে চলেছে “পিতৃতান্ত্রিকতা ও ধর্মতত্ব”–যা নারীকে অধঃস্তন করে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চায়।
সাম্প্রতিককালে জামায়াত নেতার নারীর কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বাড়ির কাজে পুরস্কার ঘোষণার মতো বক্তব্যই শুধু নয়, ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সিডও সনদ অনুমোদনের বিষয়টি নারীদের একটি বার্তা দেয়। সিডও একটি আর্ন্তজাতিক সনদ, যা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার একটি দিক নির্দেশনা। বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদে অনুস্বাক্ষর করে ধারা-২ এবং ১৬-১(গ)- এ আপত্তি জানিয়ে। ধারা-২ “বৈষম্য বিলোপ করে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপনের নীতিমালা গ্রহণ। প্রতিটি দেশের জাতীয় সংবিধান, আইন-কানুন ও নীতিমালায় নারী ও পুরুষের সমতার নীতিমালা সংযুক্তকরণ ও তার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন-কানুন, রীতিনীতি,আচার-ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ। আদালত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীকে সব ধরনের বৈষম্য থেকে রক্ষা করা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন রোধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।” আর ধারা ১৬-১(গ) “বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদকালে নারী ও পুরুষের একই অধিকার ও দায়-দায়িত্ব নিশ্চিত করা।” কী এমন বিস্ফোরক বার্তা সেখানে রয়েছে যে সিঙ্গাপুর হবার স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশ সরকার অনুস্বাক্ষর করতে পারলো না সেখানে!
ঘটনার বর্ণনা করে লাভ নেই। আশার কথা হলো–হাজারো বাধা পেরিয়ে অবহেলা-নানান বঞ্চনা-শারীরিক-মানসিক-যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী এগিয়ে চলছেন। নিজ উদ্যোগ, প্রগতিশীল মা-বাবা ও পারিবারিক সহযোগিতায় পড়ালেখা করে কিছু সংখ্যক নারী নিজ যোগ্যতায় প্রায় সকল সেক্টরে জায়গা করে নিয়েছেন-নিচ্ছেন। বাল্যবিয়ের মতো অভিশাপের শিকার হয়েও থেমে নেই নারী। কম মজুরি হলেও ভোরে উঠে বাড়ির সমস্ত কাজ শেষ করে ক্ষেতে, মানুষের বাড়িতে, রাজমিস্ত্রীর সহযোগী হিসেবে, ইটভাটায়, চা-শ্রমিক হিসেবে, ভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়ে, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন। নারী এগিয়ে গেলেন দেশের রেমিট্যান্স আনতে- আনছেনও, কিন্তু কর্মক্ষেত্র তথা সর্বক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ আজও রইলো অধরা। নারী যে গতিতে এগোচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সে গতিতে এগোতে তো পারছেই না, বরং গতি রোধ করতে নানান প্রচেষ্টা চলছে।
নারীর এগিয়ে চলার গতিতে স্বস্তির হাওয়া বয়ে আনা আর গতিরোধ করবার প্রচেষ্টার বিপরীতে উত্তরণ ঘটবার একমাত্র পথ- সুস্থ ধারার রাজনীতির বিকাশ সাধন। কারো অজানা নয়- রাজনীতিই নির্ধারণ করে দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ-বাণিজ্য-নিরাপত্তাসহ সকল ব্যবস্থা কেমন হবে। চাল-ডাল-তেলের দামসহ সকল মানুষের জীবনমান নির্ধারণ করে যে রাজনীতি, সেখানে নারীর পদচারণায় মুখরিত করে তোলার সময় এসেছে আজ। নারীর অংশগ্রহণ ব্যাতিরেকে কোনো মুক্তিই সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ ও ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন সময়ের সামাজিক আন্দোলনে নারীর সরব ভূমিকা আর জামায়াতের প্রাত্যহিক বাড়ি বাড়ি তালিমে নারীর সরব উপস্থিতি দেখা গেলেও আজও কোনো রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩% শতাংশ নারী রাখতে পারেনি। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অনুপস্থিতির কারণে নারীর জন্য কথা বলা বা নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ৫৪ বছরে দেশের শাসন ব্যবস্থায় বুর্জোয়া দলগুলোর ভূমিকা দেখেছি, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো হিসেবের খাতা থাকে না। বাম রাজনীতিবিদদের কর্তব্য হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের আস্থাভাজন হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সমাজ বদলের কর্মী হতে হলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। আত্মসমালোচনা করে নিজের ত্রুটিগুলোকে দূর করে- কাজের প্রতি পরিষ্কার ধারণা রেখে- ইতিবাচক মূল্যবোধচর্চা করে-পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করে- নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কঠোর সময়জ্ঞান নিয়ে নিজেকে তৈরি করা। ঘুনে ধরা সমাজে যে ক’জন নারী প্রতিনিয়ত পরিবারে-সহযোদ্ধাদের সাথে-সমাজে-হাজারো প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে রাজনীতি করছেন তাঁদের গতি বাড়াতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আর ৫১% নারীকে রাজনীতি সচেতন করে তোলা এখন সময়ের দাবি।
যে রাজনীতি সমাজ বদলে দিতে পারে সে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছাড়া আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচতে পারবো না, আর সাধারণ মানুষকেও সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না। আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও ন্যায্য ব্যবস্থার ভিত্তিতে বিনির্মিত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় হোক সকলের অঙ্গীকার। কাজই হোক আমাদের পরিচয়।