সংস্কৃতির অস্তিত্ব যেখানে বিপন্ন
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
পুঁজিবাদী সমাজে উঁচুস্তরের মুনাফাখোর মানুষ সর্বত্র সমাদৃত। সেই তুলনায় শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক সব সময়েই নিগ্রহের শিকার, অবহেলিত। অর্থনৈতিক প্রাপ্তির জায়গাটার পরিসরও কমে যাচ্ছে। অর্থ, খ্যাতি, মুনাফার কথা শেকড়ের শিল্পী, সাহিত্যিকরা ভাবতেই পারেন না। সরকারি প্রণোদনার অবাধ লুটপাটের মহোৎসবে এরা বরাবরই হেরে যায়। যদিও সামাজিক প্রতিপত্তি, ঐশ্বর্য এদেরকে লালায়িত করে না। বলা যায় নিরীহ, নির্মোহ প্রজাতির মানুষ। জীবন দর্শনটাই তাদের সহজ সরল।
তবে তথাকথিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং অপসংস্কৃতির ও দুর্নীতির খপ্পরে পড়ে অনেকের অবস্থা বর্তমানে নাজুক। সহসা এই বেড়াজাল ছিন্ন হবে না। সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে কেবল মাত্র রিয়েলিটি শোতে মঞ্চ কাঁপানো, সেলিব্রেটি এবং সেরা হওয়ার প্রবণতাও রাষ্ট্রীয় আয়োজনের ভেতরে আটকে আছে। যারা কেবল নিজেকে খ্যাতির চূড়ান্তে নিয়ে যেতে ব্যস্ত থাকতে অভ্যস্ত। তাদের কাছে দেশ, দেশপ্রেম, স্বজাতীয় সংস্কৃতির বিকাশমান ধারা, বিকাশমান সংস্কৃতিকে পানসে মনে হতেই পারে।
মুসলিম পরিবারগুলো একসময় ব্যাপকভাবে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির প্রকৃষ্টই লালন করেছিল। মুসলিম ধর্মীয় দর্শন এবং সুফিবাদ তার ইতিহাস, ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে পরিবেশন করা মহরমের পালাগান, কবিগান, যাত্রাপালা, জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, ওরস সুদীর্ঘকালের সাক্ষী হিসেবে এ দেশে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
অনেক মুসলিম শাসকদের প্রত্যক্ষ প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতায় এগুলো বৈশ্বিক একতা অবস্থান নিতে পেরেছিল। গ্রাম, মফস্বলের সরল বর্গীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিভিত্তিক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান করতে দ্বিধা ছিল না। নববর্ষের হালখাতা, লাঠিখেলা, বিয়ে, আকিকা, পুণ্যাহ, নবান্ন, ষাঁড়ের লড়াইকে ঘিরে নানান প্রাসঙ্গিক মেলা, বান্নি, জারিরি, পটগান, কৌতুক, নাটক, যাত্রাপালা, কবিগান, লেটো, মারফতি, মুর্শিদী, ঘাটু, থিয়েটারের পেছনে অকাতরে অনেক উদ্যোক্তা তাদের জীবনের পুরোটাই বিলিয়ে দিয়ে গেছেন।
কালক্রমে সেগুলো এখন কেবলই স্মৃতিতে লেগে আছে। প্রকৃতির উপাদান থেকে প্রাপ্ত রসসিক্ত সেসব উৎসব এখন ভাসা ভাসা, আর ফর্মালিটি হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসংগতিপূর্ণ রীতিনীতি সমাজের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। ঢুকে পড়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে মাদক, ইভটিজিং, কিশোর গ্যাঙ, জুয়া, ভিডিও গেইম, অশ্লীলতা, ক্যাসিনো।
শহুরে জীবনের কতিপয় সংগঠন বা সংস্থা বৈদেশিক আনুকূল্যে খুবই নগণ্য প্রণোদনার বিনিময়ে বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইদানীং বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার বিরুদ্ধে কতিপয় উগ্র মহল মারমুখী আচরণ, ধর্ম ব্যবহার করে সংস্কৃতি বিরোধী প্রপাগান্ডা, অপসংস্কৃতির অবাধ প্রসারে লিপ্ত। তারা বর্তমান তথ্য প্রযুক্তিকে যথেষ্ট ব্যবহার করে অপপ্রচারে সফল। বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতাকে তৃণমূলে নিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়া, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মর্মে মর্মে ঢুকে গিয়ে এই প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে।
বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধ শক্তি আজ সমাজের টপ টু বটম সক্রিয়। গান-বাজনা মুসলিম সংস্কৃতির অংশ নয়- শুধুমাত্র এই একটি কথাই ব্যাপক প্রোপাগান্ডা হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নানাভাবে ধর্মসভা, সেমিনার, সাংগঠনিক প্রোগ্রামে এই নেতিবাচক কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে বক্তৃতা চলে। আর ধর্মপ্রাণ সাধারণ, নিরর্গল মানুষের মনের গোপন ঘরের তালা উন্মুক্ত করার নামে নির্বিচারে সাংস্কৃতিক বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
এই অপতৎপরতার শুরু ব্রিটিশ-ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই। এশিয়ার এই অঞ্চলের দাপটে সংস্কৃতির ঘাড়ে পাশ্চাত্য, প্রাচ্যের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মানুষকে উদারনৈতিক চিন্তাচেতনার আদান-প্রদানে বাধা দিয়ে কেবল বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফলে শিল্প, সাহিত্যের নামে কতিপয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে। তখন অনেকেই শিল্প, সাহিত্য তথা সংস্কৃতি চর্চায় কেবলমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেছেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী ব্রিটিশ শাসকরা এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে বিভাজনের কাজে সফল হয়েছিল, কেবলই অত্র অঞ্চলের শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার মাধ্যমে। বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতা করে এ দেশের কতিপয় সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়েই আবহমান সংস্কৃতিকে ধ্বংসের বীজ রোপণ করে গেছে। তারপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও একই কায়দায় বাঙালিকে আষ্টেপৃষ্ঠে শোষণ করে গেছে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে ধর্মীয় রাজনীতির কলেবরে।
পাশাপাশি বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির নামে টিভি সিরিয়াল, সেলিব্রেটি শোতে অসংগতিপূর্ণ গান, নাচ, ফ্যাশন প্রদর্শনেও তরুণ প্রজন্ম কোণঠাসা। অনুপ্রবেশ করা রিল, টিকটক, ভিডিওতে কুৎসিত বার্তাগুলো তরুণদের বেমালুম হুজুগে হজম করতে হচ্ছে। এতে করে বিশ্বের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ক্রীড়নকদের রমরমা বাণিজ্য। আমাদের সাংস্কৃতিক মুক্তির পথটা খুঁজে খুঁজে আমরা হয়রান।
বাঙালির চিরকালের লড়াকু চেতনায় অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ, মা-বোনের সম্ভ্রমের, বিধ্বংস, জনপদের বিনিময়ে অর্জিত ইতিহাসের প্রোজ্জ্বল এক বিশ্ব কাঁপানো অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মুক্তির অবধারিত বিষয়টি জড়িয়েছিল।
কালান্তরে সেই মুক্তির আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকেছি আজও।
সনে সনে ক্ষমতায় আবরণে সরকার বদল হয়। বদল হয় ব্যক্তি। বদল হয় দল। সুকৌশলে সংবিধানের পাতা কেটে শাসন কৌশল শোষণের অস্ত্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিকদের বিপরীতে দাঁড় করানোর সংস্কৃতি অব্যাহত আছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির উত্থানকে না ঠেকিয়ে, তাদেরকে পুনর্বাসিত করে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রত্যক্ষ মদদে আজ দেশের শিল্প সংস্কৃতি হুমকির মধ্যে পড়েছে।
পাকিস্তানি কায়দায় এসেছে ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতির ওপর চড়াও হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী অপশক্তি। সম্প্রতি দেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিল্প-সংস্কৃতির শিক্ষক নিয়োগের বিপক্ষে উগ্রবাদীদের সুপারিশের প্রেক্ষিতে সেই নিয়োগের কাজটি স্থগিত করা হয়েছে। যারা শারীরিক, সংগীত শিক্ষার নির্দিষ্ট কারিকুলাম শেষ করেছে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তাদের চাকুরির অন্যতম একটা ক্ষেত্র যদি প্রাইমারি স্কুল হয়, তাহলে সমস্যাটা কী?
মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলো, যাকে সবাই ইসলামিক দেশ বলে উপস্থিত করে, সেসব দেশেও অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত শিক্ষাকেও আবশ্যকীয় ধরা হয়। অথচ আমাদের দেশে এটাকে ধর্মীয় শিক্ষার বিপরীতে দাঁড় করানোর হয়েছে। এই ধরনের রাজনীতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নতুন নয়।
গানের দেশ, প্রাণের দেশের শিশুরা নতুনভাবে সিলেবাস ধরে চর্চা করতে পারবে। তাদের মনের আবেগ, রস, কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটাবে। বিকশিত হবে সুকুমার বৃত্তির চর্চা। সবাই তো আর শিল্পী হয় না, শিল্প সাধনাতে সবাই সফলও হয় না। এটাকে ধরে রাখার উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রের পরিসর কম। প্রাইমারি স্তরে সংগীতের সিলেবাস ততটা জটিলও নয়। বিদ্যমান সংগীত বিদ্যালয়ের সিলেবাস এখানে মেইনটেইন করতে পারাটাও একটা বিষয়।
এখানে অবশ্য কতিপয় প্রশ্ন থেকে যায়। নিয়োগপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ কি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবেন? নাকি কেবল হাজিরা দিয়ে যাবেন, আর বছর বছর সরকারি খাতের অপচয় হবে? অথবা কোনো ধরনের সংগীত চর্চা হবে। দেশপ্রেম, দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য কেন্দ্রকে, নাকি দেশপ্রেম, গণমানুষের কথা বর্জিত। অথবা কেবল দলীয় অ্যাজেন্ডাভিত্তিক। কাজটির উদ্দেশ্য নিরূপণ ও যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করাটাও জরুরি।
ধর্মীয় বিষয় নিয়ে যদি আলাদা শিক্ষক নিতেই হয়, এখানে বাস্তবতা হলো প্রত্যেকটা ধর্মের জন্য আলাদাভাবে ধর্মীয় শিক্ষক নিতে হবে। অবশ্য ধর্মীয় বিষয়ে পড়ানোর সিলেবাসে অধিকাংশ শিক্ষকই দক্ষ, এ বিষয়ে শিক্ষক হিসেবে বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার হলে দিয়ে নিতে পারে।
কিন্তু সাংস্কৃতিক শিক্ষক, শরীর চর্চা বিষয়টি উপেক্ষা করার মানে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে, ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে, সেইসাথে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশমান ধারার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।
লেখক: সভাপতি, শ্যামগঞ্জ শাখা, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব লেখকের। -সম্পাদক
Login to comment..








প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন