
পৃথিবীতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি কবে চালু হয়েছে, তার সঠিক সময় নির্ণয় করা না গেলেও এটা বলা যায় যে, আদি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর, যখন মানুষ ব্যক্তিগত মালিকানায় সম্পদ ভোগ করতে শুরু করে, তারই কোনো এক পর্যায়ে এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোটা শুরু হয়। পুরাতত্ত্ববিদ মারিজা গিমবুটাস বলেন, প্রাচীন ইউরোপের এজিয়ান অঞ্চলের প্রাথমিক কৃষি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে ইউক্রেনিয়ান স্পেস থেকে আসা কুরগান (কুরগান-বিল্ডার) আক্রমণকারীদের দল বারবার আক্রমণ করলে বলকান ও দক্ষিণ ইতালিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুরুষ ক্রমোচ্চ শ্রেণি (সধষব যরবৎধৎপযু) তৈরি হয়, যার থেকে পাশ্চাত্য সমাজে পিতৃতন্ত্রের।
নৃতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো থেকে দেখা যায় যে, প্রাগৈতিহাসিক শিকারি-সংরক্ষণকারী সমাজগুলোতে তুলনামূলকভাবে বেশি লৈঙ্গিক সমতা ছিল, এবং পে-ইস্টোসিন যুগের শেষে হওয়ার অনেক পর কৃষি ও পশুর গৃহায়ণ (ফড়সবংঃরপধঃরড়হ) এর মত প্রযুক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের আগ পর্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়নি। রবার্ট এম. স্ট্রোজিয়ার-এর মতে, ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে এখনও পর্যন্ত পিতৃতন্ত্রের নির্দিষ্ট সূচনা ঘটনা পাওয়া সম্ভব হয়নি। কোনো স্কলার ছয় হাজার বছর পূর্বের (খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ) সময়কে পিতৃতন্ত্রের সূচনা বলে দাবি করেন, যখন পিতৃতন্ত্রের সূচনা হিসেবে পিতার ধারণা তৈরি হয়।
মার্ক্সবাদী তত্ত্ব অনুসারে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এবং কার্ল মার্কস একে ভিন্নভাবে দেখেছেন। তাদের মতে পিতৃতন্ত্র এসেছে একটি প্রাথমিক শ্রম বিভাগ থেকে যেখানে নারীরা গৃহের তত্ত্বাবধানে ছিল এবং কৃষির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের তত্ত্বাবধান করত। পুঁজিবাদের বিকাশের পর উৎপাদনের জগৎ মুদ্রায়িত (সড়হবঃরুবফ) হয় (মুদ্রার সাহায্যে মূল্য নির্ধারণ করাকে মুদ্রায়ন বলে), এবং গৃহের জগৎ কখনই মুদ্রায়িত হয়নি এবং তা অবমূল্যায়িত হয়। এই প্রক্রিয়ার দ্বারা নারী ও পুরুষ সম্পর্কিত ধারণা এবং পুরুষ ও নারীর ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়ে যায়।
পিতৃতন্ত্র হলো এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে কর্তৃত্বের পদগুলি মূলত পুরুষদের দ্বারা অধিষ্ঠিত। নৃবিজ্ঞানে পিতৃতন্ত্র শব্দটি পিতা বা জ্যেষ্ঠ পুরুষ বা পুরুষদের একটি গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি পরিবার বা বংশকে বর্ণনা করার জন্য। পিতৃতন্ত্রের বিকাশের কিছু পূর্বশর্ত ছিল বংশধরদের মধ্যে বর্ধিত পিতৃতান্ত্রিক বিনিয়োাগ, যাকে পিতৃত্বও বলা হয়, এবং শ্রমের যৌন বিভাজনের উত্থান। বেশ কয়েকজন গবেষক বলেছেন যে শ্রমের যৌন বিভাজনের প্রথম লক্ষণগুলি প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিল, যা মানবজাতির বিবর্তনীয় অতীতের গভীরে। এটি প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় সম্পদের ঘাটতির সময়কালে একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিল।
পিতৃতন্ত্রের ভাবনাগুলি অনুশীলন ও চর্চা এমনভাবে হতে শুরু করে যা সমাজের প্রতিটি মানুষের মনস্তাত্বিক জগতটা গ্রাস করে ফেলে। তারপর ধর্মগুলির আবির্ভাবের বা প্রচলন শুরু হলে পিতৃতন্ত্রটা পবিত্রতা প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রতিটি অনুশাসনে পিতৃতন্ত্রের ধারাগুলো স্রষ্টার বাণীতে হিসেবে প্রচারিত হয়। তখনই থেকেই পিতৃতন্ত্র এর প্রথাগুলো সমাজের অনুশাসনের রূপ লাভ করে। পুরুষেরা হয়ে উঠে নারীর নারীর নিয়ন্ত্রক হিসেসে। এই নিয়ন্ত্রক ভাবনাটা চলে আসে বংশপরম্পরায়। যৌন শ্রম বিভাজনের ফলে নারীকে নির্দিষ্ট কাজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করা হয়। এই আবদ্ধতাটা নারীর মনোজগতে এক ধরনের পরির্বতন ঘটায়। নারীরাও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই ভাবনায় বড় হয় তাদের জীবনের একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিবদ্ধতা নিয়ে যায়। পিতৃতন্ত্র নারীদের জন্য নির্ধারণ করা প্রথাগুলো হয়ে উঠে নারীর জন্য পালনীয়। প্রথাগুলো পালন না করলে পাপ হবে বলে নারীরাই মনে করেন। এভাবে মাতৃতান্ত্রিক কেন্দ্রিক সভ্যতায় সৃষ্টি হওয়া পৃথিবীটা একটি জায়গায় গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়ে। নারীর শ্রমটা মূল্যহীন হয়ে যায়। নারীরা হয়ে যায় পুরুষের আদেশের পালনকারী। শ্রম বিভাজনের ফলে গৃহস্থালির নানাবিধ কাজ নারীরাই করবে, এই ধারণাটা নারী-পুরুষ সবার মাঝে জন্ম নেয়। এই ভাবনাটা মনোজগতে এমন ভাবেই প্রোথিত হয় যে, এই ব্যবস্থা থেকে নারীদের বের করার উদ্যোগটা যে নিবে, সে পাপী হয়ে যাবে। গত কিছুদিন আগে, একটা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলাম। কেবিনটার ফ্লোর মুছতে আসল ক্লিনার , ক্লিনিং করার পর আমি দেখলাম তা যথেষ্ট ভালোভাবে পরিষ্কার হয়নি, এই কারণে তাকে বললাম, আমি বাসায় এর চাইতে সুন্দর করে ফ্লোর মুছি। শুনে এই রুমের দায়িত্ব পালনকারী নার্স বলে উঠলেন, কি বলেন স্যার, ম্যাডাম আপনাকে দিয়ে ঘর মুছোয়। বিষয়টি নার্সের কাছে খুবই অবাক করার মত বিষয়। তার ধারণা আমি স্ত্রী দ্বারা নির্যাতিত এটাই তার মুখাভঙ্গিতে ফোটে উঠে। আমি তাকে বললাম কেন আপনার স্বামী করে না? তিনি বললেন, এটা তো গৃহস্থালীর কাজ পুরুষ মানুষ করবে কেন? নার্স বললেন- এই কাজটা আমিই করি। জেনে নিলাম তার স্বামী চাকুরি করে একটি সরকারি অফিসে, নয়টা পাঁচটা ডিউটি, এবং তিনি গৃহস্থালির কোনো কাজ করেন না তবে বাজার করেন। একবার রক্ত পরীক্ষা করাতে গেলাম, যে তরুণটি আমার শরীর থেকে রক্ত নিলেন, তার বয়স উনিশ কি বিশ হবে। রক্ত নিতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কিছু রক্ত আমার শার্টের হাতায় লেগে গেল। তরুণটি তাড়াতাড়ি রক্ত ঝরাটা বন্ধ করল। এবং এই অনভিপ্রেত ঘটনায় খুব লজ্জাও পেল। শার্টের রক্ত লাগায় তরুণটি আমায় পরামর্শ দিল, আঙ্কেল তাড়াতাড়ি বাসায় যান, বাসায় গিয়ে আন্টিকে বলুন ডিটারজেন্ট দিয়ে শার্টটা ধুয়ে ফেলতে। তারমতে এই শাট ধোয়া কাজটা একজন নারীর কাজ। তাকে আমি বললাম, শোন শার্টটা যদি আমি ধুই তাতে কি সমস্যা আছে। ১৯/২০ বছরের তরুণটির মনোজগতটা পুরুষতান্ত্রিকতার গণ্ডিজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সমাজের প্রতিটি মানুষের নারী সম্পর্কে ধারনা টা হলো , নারীর জন্ম হয়েছে গৃহস্থালি কাজ করার জন্য বাইরের জগতটা তার জন্য নিষিদ্ধ। কারণ বাইরে গেলে নারী নষ্টা হয়ে যায়। গ্রীস্মের প্রচণ্ড দাবদাহে নারীকে ঘরের বাইরে যেতে হলে কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়ে বের হতে হবে। বাইরের তাপমাত্র ৪২ ডিগ্রি তারপরও কালো ট্রেটনের তাপকুপরিবাহী কাপড় পড়ে তাকে বাইরে বের হতে হচ্ছে। পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাচানোর জন্য নারীর এই পর্দা ব্যবস্থা। নারীর প্রতি পুরুষের বা সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গিটা কেমন তা সুর্নিদিষ্ট শব্দ দ্ধারা বর্ননা করা যাবে না। এর বনর্না ব্যাখ্যা বহুবিদ স্থান কাল অঞ্চল ভেদে। যেমন , নারীর দেহের সৌষ্ঠতা পুরুষের মনের যৌন চেতনা জাগ্রত করে তাই নারীর দেহকে কভারে মোড়াতে হবে। যদি নারীর দেহ দেখে পুরুষ যৌনময় হয়, এর দায়ভারটা নারীর উপর বর্তায়। আবার পুরুষের দৈহিক সৌষ্ঠবতায় কোন নারী আকৃষ্ট হলে তা হবে ঐ নারীর জন্য পাপ কাজ। আমাদের সমাজের বহু পুরুষ আছেন, তারা নিজের স্ত্রী-কন্যাকে হিজাবে আবৃত করে রাখেন। আবার তারাই অন্যের স্ত্রী-কন্যার প্রতি রাস্তাঘাটে লোলুপ দৃষ্টি ফেলেন।
তাই পিতৃতন্ত্র কেবল আলাদা আলাদা ব্যক্তির লিঙ্গবাদই নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের সাথেও সম্পর্কিত। যেখানে পুরুষেরা বাড়ির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে যোগ্যতাগত পূর্ণতা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে, সেখানে নারীকে স্টেরিওটাইপগতভাবে একটি গৃহপালিত চরিত্র হিসেবেই চিন্তা করা হচ্ছে। বৈষম্য ও নির্যাতনের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো ঐতিহাসিকভাবে নারীকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে পুরুষদের সুবিধা প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যদি নারীর সুযোগকে এর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গভাবে নির্মূল করা হয়েছে। এর ফলস্বরূপ নারীর জীবন হয়েছে সীমাবদ্ধ। যদিও সকল সমাজেই নেতা এবং নেতৃত্ব থাকা আবশ্যক, পিতৃতন্ত্রের নারীর নেতা হওয়ার সুযোগ নাই। গতানুগতিকভাবে পিতৃতন্ত্রের বিধান মতে পরিবারের পিতাকে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের ওপর পূর্ণাঙ্গ অধিকার দান করেছে। উনিশ ও বিশ শতকে ক্রোয়েশিয়া, কসোভো এবং বসনিয়ায় সার্বগণ সেই অঞ্চলের নারীদের ধর্ষণ করাকে সমরকৌশল হিসবে ব্যবহার করতেন, এবং ধর্ষণ কর্মটিকে তেমন গুরুত্ব¡ সহকারে বিবেচ্য হত না, অর্থ্যৎ এটা কোন অন্যায় না। সুতরাং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বলয়ে নারীকে এখনও কোন কোন জায়গায় যৌন সামগ্রীর ব্যবহার্য উপরণ মনে করা হয়। অথচ আদি মানব সভ্যতার বিকাশটা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মাতৃতন্ত্র হল মানুষের সভ্যতার সুচনার একটি সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে নারীরা কর্তৃত্ব ক্ষমতার অবস্থানে ছিলেন। এই ব্যবস্থায় সমস্ত সমাজ ব্যবস্থায় তথা পরিবারের নৈতিক কর্তৃত্ব, সামাজিক বিশেষাধিকার এবং সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নারীদের নির্দেশনায় পরিচালিত হত। বর্তমানে এই ব্যবস্থাটা ইউটার্ন হয়ে কর্তৃত্ব চলে এসেছে পুরুষদের হাতে। তাই এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটানোটা জরুরি।
রাষ্ট্র কর্তৃক বিধি বিধান তৈরির মাধ্যমে সমাজে নারী-পুরুষ তথা মানুষের সমতা আনতে হবে। এই সমতাচর্চার মাধ্যমে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।