পার্টি কংগ্রেসের সামনে চ্যালেঞ্জ এবার নামতে হবে কোমর বেঁধে
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
জাতীয় রাজনীতির কয়েকটি দিক-নির্ধারণমূলক চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তার ত্রয়োদশ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করছে। পার্টির এই চার দিনের কংগ্রেসের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আজ উপস্থিত হয়েছে সেগুলো কী?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এসব চ্যালেঞ্জ তেমন কোনো বড় বিষয় নয়। কিন্তু, পরিস্থিতির জটিলতা ও রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাসের যা বিদ্যমান অবস্থা - সেই বিবেচনায় এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। দেশের শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুর মেহনতি মানুষ এবং গরিব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষসহ জনগণ ‘শোষণ-বৈষম্যমুক্ত’ এবং নিরবচ্ছিন্ন ও পরিপূর্ণ ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজে’ বাস করার স্বপ্ন দেখে চলেছে। ‘২৪-এর রক্তঝরা ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে নবায়িত শক্তিতে জেগে ওঠা জন-আকাঙ্ক্ষা রূপায়নের স্বপ্নকে আজ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জিং কাজটি কমিউনিস্ট-বামপন্থি-প্রগতিবাদী শক্তি এবং এদেশের শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে আপন কাঁধে তুলে না নিলে তা সম্পন্ন হবে না।
দেশে দশকের পর দশক ধরে চলছে সর্বগ্রাসী রুগ্নতা ও অবক্ষয়ের পালা। সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ। এই অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে উদ্ধার পাওয়ার কাজটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের কাজ। দূর থেকে ‘মেটিকুলাস প্ল্যানিং’, ‘জনৈক মাস্টার মাইন্ডের বুদ্ধিমত্তা’ ও ‘ছদ্মবেশ ধারণ করে শত্রু শিবিরে অনুপ্রবেশ করে’ নিরাপদ নিরাপত্তায় থাকা কয়েকজন দৃঢ়চেতা মানুষের দ্বারা এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কারণ, আমরা বাস করছি এমন একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে, এমন একটি ৯৯% শোষিত-বঞ্চিত বনাম ১% শোষক-জালেমের শাসনে পদানত অবস্থায়, শ্রেণি বিভাজনে বিভাজিত এমন এক বাস্তবতায়, যেখানে রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রে অবধারিতভাবে পৃথক-পৃথক শ্রেণি স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটে চলেছে। ইতিহাস এই সত্যিই তুলে ধরে যে- ‘রাজনীতি হলো অর্থনীতিরই ঘনীভূত প্রকাশ’। তাই, শাষক-শোষক শ্রেণির লালিত ‘জাহান্নামের আগুনে’ বাস করে সমাজের কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই ছাড়া ছোট্ট একটি ‘পুষ্প’-ও ফোটানো সম্ভব নয়। ছোট-ছোট পুষ্প ফোটানোর জন্য সংগ্রামের প্রক্রিয়াকে সচেতনভাবে শোষণমুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্যের পথে এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়েই সেই অনিন্দ্যসুন্দর ‘শোষণ-বৈষম্যহীন পুষ্প উদ্যানের স্বপ্ন’ নির্মাণ করা সম্ভব হতে পারে।
১% লুটেরা-শোষক শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতাকে তাদের দখলে রেখে রাষ্ট্রযন্ত্র, তথা সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, পুলিশ-মিলিটারী, আইন-আদালত ইত্যাদির শিকলে ৯৯% মানুষকে পুঁজিবাদী শোষণ ব্যাবস্থার জিঞ্জিরে বন্দী করে রেখেছে। তাছাড়া, দেশের ভেতরের শোষক শ্রেণির পাশাপাশি আমাদের ওপর চেপে বসে আছে মহা-শক্তিধর আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও আঞ্চলিক আধিপত্ববাদের শোষণ-শাসন যন্ত্র। দেশি-বিদেশি যে শোষকচক্র দেশ ও দেশবাসীকে লোহার জিঞ্জিরে আটক করে রেখেছে, শ্রেণি-আন্দোলন ও গণআন্দোলনের বজ্রসম জনশক্তিই কেবল সেই জিঞ্জির ভাঙতে সক্ষম।’
প্রবল শক্তিধর দেশি-বিদেশি শাসক-শোষকেরা ছলে-বলে-কৌশলে, নানামুখে, নানাপথে, প্রকাশ্যে, গোপনে, বাইরে থেকে, ভেতর থেকে, বন্ধু সেজে, ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে— সম্ভাব্য সব উপায়ে ‘শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সমাজ’ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রযাত্রা ঠেকাতে মরিয়া। এ কারণেই তারা ‘জনগণই রাষ্ট্রের মালিক’ সংবিধানের এই মৌলিক নীতির ভিত্তিতে নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পথে দেশ চালাতে অক্ষম। তাদের শ্রেণি-শোষণ ও লুটপাট বজায় রাখার স্বার্থে ও প্রয়োজনে তারা তাই ভেজাল গণতন্ত্র, স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট শাসন ইত্যাদি পথের আশ্রয় নেয়। তাই, একটি মৌলিক সমাজ বিপ্লব ছাড়া চলমান রাজনীতিতে চলতে থাকা রুগ্নতা, অনাচার, পচনের প্রক্রিয়া ইত্যাদি দূর করা যাবে না।
দেশি-বিদেশি শাসক-শোষকদের দ্বারা পদে পদে বাধা দান-বিভ্রান্তি ছড়ানো-লুটপাটের ছিটেফোঁটা উচ্ছিষ্টের প্রলোভন, জেল-জলুম-অত্যাচার সবকিছুকে মোকাবিলা করে গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নই হলো মেহনতি মানুষ ও জনগণের সামনে আজ এক নম্বরের চ্যালেঞ্জ। মেহনতি মানুষের সামনে যেটি প্রধান চ্যালেঞ্জ– কমিউনিস্টদের জন্যও সেটিই হলো মূল চ্যালেঞ্জিং কর্তব্য। তাই সে কর্তব্য পালনে সুনির্দিষ্ট করণীয় চিহ্নিত করে ‘কোমর বেঁধে নেমে পড়ার’ সিদ্ধান্ত নিতে পারাই হলো ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসের সামনে প্রধান এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
উত্থিত জনশক্তি যেকোনো মহা শক্তিধর জালিমকেও যে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎখাত করার সক্ষমতা রাখে, সে কথা জনগণের চেতনা ও উপলব্ধিতে অনেকটাই প্রবিষ্ট হয়েছে। ২৪-এর ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান’ এই সত্যেরই প্রকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু, ‘গদি ছাড়ো’-র সগ্রামে বিজয়ের পথ-পন্থা অনেকটা চিনে উঠতে পারলেও, সর্বস্তরের মানুষ এখনো কিভাবে যে জনগণের স্বার্থের একটি সরকার স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, সেই সরকারকে কিভাবে ও কোন নীতি কৌশলে রাষ্ট্র চালাতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ভূমিকা যে প্রত্যক্ষ হওয়া অপরিহার্য- এসব বিষয় সম্পর্কে তার চেতনা ও উপলব্ধি গড়ে ওঠার সুযোগ ও সম্ভাবনা কিছুটা সূচিত হলেও তা এখনো প্রয়োজনীয় মাত্রায় পরিপুষ্ট নয়। ‘চেতনার অসম বিকাশ’ হলো সমাজ বিকাশের একটি নিয়ম। সবাই আপনা-আপনি সবক্ষেত্রে একইসাথে একই মাত্রায় সচেতনতা লাভ করে না। সেকারণে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জনগণকে, বিশেষত শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে, চেতনায় উন্নীত করা। চেতনা তথা তত্ত্বের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মানুষকে ‘ছবক’, ‘ভাষণ’, ‘পাঠচক্র’ ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনীতির পাঠ দিতে হবে মনে রাখতে হবে– ‘তত্ত্ব ছাড়া প্রয়োগ যেমন কি না অন্ধ, তেমনি প্রয়োগ ছাড়া তত্ত্ব হল বন্ধ্যা’। এক্ষেত্রে একথাটি মনে রাখা একান্তভাবে প্রয়োজন যে, তত্ত্বচর্চার ১০০ দিনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমে একজন মানুষের চেতনার যেটুকু বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়, একদিনের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা হাজার-লক্ষ-কোটি মানুষের চেতনাকে লাফ দিয়ে তার থেকে অনেকগুণ বেশি বৃদ্ধি করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
স্বাধীনতার পরবর্তী অর্ধশতাব্দির বেশি সময়ে মুক্তযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরে মৌলিক অগ্রগতি হয়নি। সে স্বপ্ন বারবার পদে পদে হোঁচট খেয়েছে, দেশকে তার উল্টা পথে চলানো হয়েছে, প্রতিযোগিতা করে সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্ববাদের পদলেহন করা হয়েছে, জনজীবনের সমস্যা-যন্ত্রণা-সংকট অব্যাহতভাবে বেড়েছে, বেড়েছে শোষণ-বৈষম্য-ঘুষ-দুর্নীতি-বেপরোয়া লুটপাট-দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়া ইত্যাদি। এ সবই হলো লুটপাটের অর্থনীতির ধারায় দেশ চালানোর স্বাভাবিক পরিণতি- পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার অবধারিত দেউলিয়াপনা, ব্যর্থতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
এই অবস্থার মুখে ঘটেছে ’২৪-এর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের’ বিস্ফোরণ। মাত্র কয়েক দিনে হাজার খানেক ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে ষোল বছর ধরে একটানা চেপে বসা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। ঘটেছে সরকারের বদল।
এটি মূলত ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান। যা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ তা একইসাথে ‘মাস্টারমাইন্ড ও মেটিকুলাস প্ল্যানিং’-এর ফসল হতে পারে না।
গণঅভ্যুত্থান ছিল প্রধানত ছাত্র-জনতার অজেয় কীর্তি। তাদের হাতে আঁকা সিংহভাগ গ্রাফিটিতে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার ছবির পাশে বড় হরফে উৎকীর্ণ ছিল- “ধর্ম যার যার- রাষ্ট্র সবার” এবং “স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনবো”। যারা ছিলেন গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত নায়ক, এসব বাণীর মাঝেই প্রকাশ পেয়েছিল তাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্নের স্বরূপ।
কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত নায়ক জনগণের হাতে ক্ষমতা আসেনি। ফলে তাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। তাদের প্রত্যাশা মতো ‘শোষণ-বৈষম্যবিরোধী বিকল্প ব্যবস্থায়’ রাষ্ট্রের আগ্রগতি সূচনা করা যায়নি। সরকার বদল হয়ে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের বছরাধিক শাসনকালে দেশে চলেছে একটি অনিশ্চিত, তরল (fluid) অবস্থা, ‘কখন কী হয়’-এর অবস্থা । গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত কারিগর গণদেবতা দূরে ঠেলে রেখে, তাদের অর্জনকে দখলে নিতে, যে গোষ্ঠীগত কামড়া-কামড়ি ও রশি টানাটানিতে দেশ নৈরাজ্যে নিপতিত হয়।
ইতালির প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী বিপ্লবী আনতোনিও গ্রামসির একটি বর্ণনার সাথে আমাদের দেশের বর্তমান এহেন পরিস্থিতির মিল থাকায় তাঁকে উদ্ধৃত করছি। তিনি লিখেছেন–
‘The crisis consists precisely in the fact that the old is dying and the nwe cannot be born’ ― Antonio Gramsci
“বিরাজমান সংকট এই নিখুত সত্যের দ্বারা ব্যক্ত যে ‘যা পুরানো’ তা মৃত্যুপথযাত্রী, এবং ‘যেটা নতুন’ তা জন্ম নিতে পারছে না”। (অনুবাদ-লেখক)।
নৈরাজ্য ও রাষ্ট্রক্ষমতার ক্ষেত্রে একধরনের যে শূন্যতা বিরাজ করছে তার সুযোগে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে মাঠে নেমেছে এবং তারা দেশকে আরও পেছনে নিয়ে যাওয়ার উন্মত্ত চক্রান্তে মেতে উঠেছে। গণঅভ্যুত্থানে যে স্বপ্ন ছাত্র-জনতার মাঝে পুনর্বার জেগে উঠেছিলো, জামায়াত-শিবিরের মতো স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক কালো শক্তির মধ্যযুগীয় ‘পশ্চাদমুখী বিকল্প’ দিয়ে তো নয়ই, এমনকি ‘পুঁজিবাদী মুক্তবাজার নীতি’ অনুসরণকারী পূর্বতন সরকারগুলোর কোনো ‘উন্নত নব-সংস্করণ’ দ্বারাও সেই স্বপ্নের রূপায়ন সম্ভব নয়। তা রূপায়নে অপরিহার্য হ’লোর ‘সমাজতন্ত্র অভিমুখীন বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প’ ব্যবস্থা, এবং সে ব্যবস্থার স্বপক্ষের একটি প্রকৃত ‘বিকল্প সরকার’। রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘বাম-প্রগতিশীল বিকল্প’ প্রতিষ্ঠা না করে ‘ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র’ (Fascist Dictatorship)-এর জায়গায় ‘জনকল্যাণকর একনায়কতন্ত্র’ (Benevolent Dictatorship) স্থাপন করে কাজ হবে না।
‘২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্নপূরণের কাজ শেষ হয়নি। সামনে আছে আরও বড় লড়াই। আছে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা। ইতিহাসে আমরা একের পর এক অনেক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করলেও, প্রতিবারই সে বিজয় কম-বেশি হাতছাড়া হয়ে গেছে। বিজয় অর্জন করেও তা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার এই ট্র্যাজিক পরিণতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেজন্য রাজনীতির হাল ধরতে হবে শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষকে এবং দেশের কমিউনিস্ট-বামপন্থি-প্রগতিশীল দল শক্তি ও ব্যক্তিকে। এই কর্তব্যের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে সামনে এসেছে। যুগের প্রয়োজনে এই দায়িত্ব সাহসের সাথে গ্রহণ করা আজ পার্টির জন্য অপরিহার্য ও প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
আজ প্রয়োজন এমন একটি সমাজ বিপ্লব যার গতিমুখ হবে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন। এবং উপযুক্তভাবে সচেতন-সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি ও অপরাপর মেহনতি মানুষকে, বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীকে, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনগণকে সাথে নিয়ে একটি ‘নয়া বন্দোবস্তের’ সামাজিক মেরুকরণে একত্রিত শক্তি-সমাবেশকে জনশক্তির জাগ্রত বলে বলিয়ান হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার ‘ড্রাইভিং সিটে’ অধিষ্ঠিত করতে হবে।
সমাজ বিপ্লবের এই মৌলিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজটি একলাফে হবে না। শ্রেণি-পেশা-আত্মপরিচয় (identity politics) ভিত্তিক অসংখ্য আশু ও খণ্ডিত ন্যায্য ইস্যুতে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে শ্রেণি-সংগ্রাম ও গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। নানা চড়াই-উৎড়াই, উত্থান-পতনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে নিতে হবে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন ব্যবস্থা ও তার অনুকূলে বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক বিকল্প ধারার সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট মুহূর্তের প্রকৃত রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাসের সমীকরণ অনুসারে চূড়ান্ত লক্ষ্যাভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার অনুকূল হয়, সরকার সম্পর্কে সেরূপ উপযুক্ত আশু স্লোগান তুলতে হবে এবং সেজন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কমিউনিস্ট ইশতেহারের সেই কথাটি মনে রেখে চলতে হবে- “কমিউনিস্টরা আন্দোলনের বর্তমানের মধ্যে থেকে তার ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করে”। অর্থাৎ, সংগ্রামের বর্তমান পর্ব সম্পর্কে উদাসীনতা অথবা তাতে গা ভাসিয়ে দেয়া উভয় চিন্তাই ভুল। আবার, চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা তুলে আশু কর্তব্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা অথবা আশু কর্তব্য শেষ করার যক্তিতে চূড়ান্ত লক্ষ্যের বিষয়কে পেন্ডিং রাখা- এক্ষেত্রেও উভয় দৃষ্টিভঙ্গি হলো ভ্রান্ত। আশু, মধ্যবর্তী, চূড়ান্ত সবগুলো লক্ষ্য দ্বান্দ্বিকভাবে (dialectically) সম্পর্কিত।
এসবই হলো কঠিন কাজ। এই লক্ষ্যাভিমুখে যাত্রাপথ কুসুমাদ্রিত নয়। এ পথে যাত্রা হলো ‘চলতি হাওয়ার বিপরীতে’ পথ চলা। পথে পথে থাকবে শোষক গোষ্ঠির নানামুখী হামলা। তারা প্রথমে গণ্য না করার ‘নীরবতার’ অস্ত্র প্রয়োগ দ্বারা, আরও পরে মার্কসের চেয়ে বড় মার্কসবাদী সেজে বিপ্লবী তত্ত্বের বিকৃতি সাধন করে আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করার অপচেষ্টা দ্বারা, নেতাদের লোভ দেখিয়ে কিনে নেওয়ার দ্বারা এবং শেষমেশ ‘সাধারণ জ্ঞান’ দিয়ে পথের সঠিক নিশানা পাওয়া যায়নি। প্রয়োজন ‘বিশেষ জ্ঞানের’।
জনগণ, বিশেষত শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সাথে নিবিড় সম্পর্ককে ভিত্তি করে সংগ্রাম-আন্দোলনের ধারাকে বেগবান করতে মাঠে-ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। জেন-জি তথা তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-কাজের সাথে সেতুবন্ধন গড়ে তাদের সৃজনশীলতা ও উত্তাল জীবনীশক্তির উদ্যোগকে ধারণ করতে হবে। তৃণমূলে পড়ে থেকে কাজ করা এবং সেখান থেকে গণজাগরণের উত্থান ঘটানোর কাজে নেমে পড়তে হবে। শ্রমিক-ক্ষেতমজুর-কৃষক তথা সংগঠিত-অসংগঠিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেহনতি মানুষের সব অংশের আংশিক দাবিদাওয়া নিয়ে স্থানীয় পর্যায় ও জাতীয় পর্যায়ে সংগ্রাম পরিচালনায় ধারাবাহিক কাজ করতে হবে, সমাজতন্ত্র ও পার্টির পক্ষে এবং সাধারণভাবে বামপন্থা-প্রগতিশীলতার অনুকূলে একটি আদর্শনিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি সংগঠিত করে বিশাল পরিসরে আদর্শগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, মনস্তাত্বিক–প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রমে হাত দিতে হবে। - ইত্যাদি।
এসব মৌলিক কাজের সাথে সাথে জাতীয় রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান থেকে জাতির সামনে ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে হাজির হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘নয়া যুক্তফ্রন্টের সরকার’ গঠনের লক্ষ্যে জোরদার তৎপরতা চালাতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পার্টিকে তার ভূমিকা ও উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
এসব কাজ করার জন্য যথোপযুক্ত সংগঠন আবশ্যক। সেজন্য গণসংগঠনগুলোর মধ্যে বিভেদ দূর করতে জরুরিভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। বামপন্থিদের একত্রিত করে ‘বাম-গণতান্ত্রিক ঐক্য’ মজবুত করতে হবে। কমিউনিস্ট ঐক্যের লক্ষ্যে নতুনভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এসব কাজের ক্ষেত্রে পার্টি অনেক পিছিয়ে পড়েছে। সময় অনেক নষ্ট হয়েছে। ‘ওভার টাইম’ কাজ করে হারানো সময় পুনরুদ্ধার ও পিছিয়ে পড়া উদ্যোগ ফিরিয়ে আনতে হবে।
সেকারণে, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারাটাই হলো ত্রয়োদশ পার্টি কগ্রেসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জিততে হবে।
Login to comment..