দেশে প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছায় একীভূত হলো বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক। এর ফলে, পদ্মা ব্যাংকের যেকোনো ব্যক্তিগত আমানতকারী দ্রুতই এক্সিম ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন বলে জানিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এই একীভূতির ফলে, পরিচালনা পর্ষদে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন এক্সিম ব্যাংকের পরিচালকরা। তবে দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া, পদ্মা ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা চাকরি হারাবেন না বলেও আশ্বস্ত করেছেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে দুই ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষর শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, পদ্মায় জাল ফেলেছে এক্সিম ব্যাংক। এখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার পালা। এক বছরের মধ্যে পদ্মা ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে। চাইলে পদ্মা ব্যাংকের যেকোনো ব্যক্তিগত আমানতকারী তার টাকা এক্সিম ব্যাংক থেকেই তুলে নিতে পারবেন। আর ব্যাংকের সকল দায়ভার এখন থেকে এক্সিম ব্যাংক গ্রহণ করল, যোগ করেন তিনি। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, মার্জার প্রক্রিয়ায় এখনও শেষ হয়নি। শেষ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করবে। এরপর থেকে তারা একত্রে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এই প্রক্রিয়ার পরেই পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীরা এক্সিম ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন। এর আগে, গত ১৪ মার্চ সকালে ব্যাংকের পর্ষদ সভায় পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডকে অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এক্সিম ব্যাংক। দ্য ফারমার্স ব্যাংক নামে ২০১৩ সালে পদ্মা ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। এরপর ২০১৭ সালে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনিও পদত্যাগ করেন কিন্তু শুরু থেকেই ব্যাপক অনিয়মের কারণে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়।
দেশে ২০১৩ সালে নতুন যে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন পায়, তার একটি হলো পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স)। শুরু থেকেই পদ্মা ব্যাংকের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করেছিল। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারিতে দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। এ রকম অবস্থায় শরীয়াহ্ভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়েছে পদ্মা। এর ফলে ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংকের নাম। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর দেশছাড়া হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তাঁর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী। গত বছরের অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাঁদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে।
একটি ব্যাংক টিকে থাকার মূল শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো অর্থ ও বন্ড জমা রাখা, সেটিতেও ছাড় দেওয়া হয় ব্যাংকটিকে। ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র গোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর সুযোগও করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটির ওপর আমানতকারীদের অনাস্থা বেড়ে যায়। উল্লেখ্য ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৬২ শতাংশ। ফলে ঋণ থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ব্যাংকটি এখন বড় লোকসানে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে গত মাসের শুরুতে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পর থেকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম পদ্মা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সোনালী ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির পরিচালক। সম্প্রতি পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যেটা কার্যকর হয়েছে। তবে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর অবাধ লুটপাটের স্বাক্ষর বহন করছে সাবেক ফার্মাস ব্যাংক, সাবেক পদ্মা ব্যাংক।