কমরেড খোকা রায় স্মরণে

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
একতা ডেস্ক : [কমিউনিস্ট নেতা কমরেড খোকা রায় ১৯৯২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। দিবসটি স্মরণে খোকা রায়ের লেখা ‘সংগ্রামের তিন দশক’ গ্রন্থ (যা তাঁর কন্যা জয়শ্রী গাঙ্গুলি কর্তৃক কলকাতা থেকে প্রকাশিত) থেকে তার নিজের লেখা স্মৃতিচারণ অংশটুকু এখানে একতা’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। এ অংশে কমরেড খোকা রায় নিজের জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। - সম্পাদক] ১৯০৭ সালের মার্চ মাসে অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করি। স্থানীয় সিটি কলেজিয়েট স্কুলে ছাত্রজীবন শুরু করি, এবং যখন আমি ঐ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র তখনই ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তথা মহাত্মাজীর আহ্বানে ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিই এবং ঐ সময়েই যুগান্তর নামে যে বিপ্লবী দল ছিল সেই দলের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে যোগ দিই। এইভাবেই ১৫ বছর বয়সে মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে আমার যোগদান। ১৯২৪ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি স্থানীয় আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হই এবং ১৯২৮ সালে ঐ কলেজ থেকেই আমি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি। এরপর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশুনার জন্য ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই জগন্নাথ ছাত্রাবাসে থাকতাম। এখানে একটা কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯২১ থেকে ১৯২৯ অবধি এই ক’বছর কিন্তু আমি আমার গোপনীয় বিপ্লবী কার্যকলাপ ঠিক চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি এবং আমার কয়েকজন বিপ্লবী সাথী মিলে যুগান্তর দলের একটা গোপন বিভাগ (গুপ্ত বিভাগ) সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলাম। এই বিপ্লবী কার্যকলাপের পাশাপাশি ১৯৩০ সালে আমি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলনেও যোগ দিই এবং পরবর্তীকালে এই বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিভাগ (ইউনিটের) সম্পাদক নিযুক্ত হই। এই সময়ে ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি কংগ্রেস স্বাধীনতা ঘোষণা করল এবং (পার্কে, হাটে, মাঠে) সর্বত্র কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন, জনসভা ও বিক্ষোভের মাধ্যমে দিনটি উদযাপনের জন্য জনগণের কাছে আবেদন রাখল। কংগ্রেসের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা জগন্নাথ ছাত্রাবাসের উত্তর ও দক্ষিণ-অলিন্দে বসবাসকারী কংগ্রেসের কর্মী ও সমর্থকরা ছাত্রাবাস চত্বরে পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। ছাত্রাবাস কর্তৃপক্ষ পতাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন কিন্তু আমরা সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পতাকা উত্তোলন করি এবং সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে এই ভয়ে ছাত্রাবাস কর্তৃপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একটা সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্তৃপক্ষ আমাকে ও আমার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মীকে ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কার করে তাদের প্রতিহিংসার স্বার্থ চরিতার্থ করে। ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কারের পর আমি ও আমার ঐ সহকর্মী ঢাকা কংগ্রেস কার্যালয়ে থাকতাম এবং কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় মদ ও গাঁজার দোকানের সামনে পথসভা করতাম। এর কিছুদিন পর ১৯৩০ এর মার্চ-এপ্রিল মাসে আমি ময়মনসিংহে ফিরে আসি এবং আমার পুরনো সহকর্মীদের সাথে আবার কংগ্রেসের আন্দোলনে যোগ দিই। এই সময় যুগান্তর দলীয় কর্মীদের উদ্যোগে ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস কমিটি এক সিদ্ধান্ত নেয় যে, যদি শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গুদাম ঘর থেকে জেলার সমস্ত খুচরা দোকানগুলিতে মদ ও গাঁজার যোগান বন্ধ করা যায় তাহলে এই দোকানগুলিও কোনও রকম পথসভা ছাড়া এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। এবং এই প্রস্তাবকে কার্যকরী করতে কেন্দ্রীয় গুদাম ঘরের ঠিক বাইরের একটা পরিখা খনন করা হল এবং যুগান্তর দলের সক্রিয় কর্মী ধীরেন রায়ের নেতৃত্বে একদল কংগ্রেস কর্মী- যাতে এক ছটাকও মদ বা গাঁজা এখান থেকে অন্যত্র যোগান না যায় সে ব্যাপারে প্রহরার জন্য সেই পরিখার ভেতর আশ্রয় নিল। এর ফলে খুচরো গাঁজা ও মদের দোকানগুলি যোগানের অভাবে একটার পর একটা করে বন্ধ হয়ে গেল। অন্যদিকে চুঙ্গি কর আদায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলা প্রশাসনকে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হল, আবার ১৯৩০ এর জুনের ভেতর মদ ও গাঁজার খুচরো দোকানের লাইসেন্স স্বীকৃত না হলে লাইসেন্স (খরপবহপব) বাতিল হয়ে যাবে- এই দুই পরিস্থিতির সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসন কেন্দ্রীয় গুদাম ঘর থেকে মদ ও গাঁজার যোগান শুরু করার ব্যাপারে এক ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন; এবং জুন ১৮, ১৯৩০ এ কংগ্রেসী স্বেচ্ছাসেবীদের পথসভা সত্ত্বেও ‘দরকার হলে বল প্রয়োগ করা হবে’ এই ভয় দেখিয়ে তাঁরা যোগান পুনরায় শুরু করার ব্যবস্থা করলেন। এমন জটিল অবস্থায় জেলা কংগ্রেসের ডান ঘেঁষা নেতারা কী করবেন সে ব্যাপারে ইতস্তত করতে থাকেন। কিন্তু আমরা যুগান্তর দলের সক্রিয় কর্মীরা স্থানীয় প্রশাসনের এই হুমকিতে একটুও পিছু না হটে শহর ও শহরতলীর জনগণের কাছে কেন্দ্রীয় গুদাম ঘরের ওপর নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার আবেদন রাখলাম; এবং বলাবাহুল্য আমাদের এই আহ্বানে আমরা জনগণের তরফ থেকে ভাল সাড়া পেলাম এবং ঐ দিন দুপুর থেকেই হাজার হাজার লোক গুদাম ঘরের সামনে জমায়েত হল এবং স্বেচ্ছাসেবী নেতা ধীরেন রায়কে সহায়তা করতে এবং ঐ জমায়েতকে সফল রূপ দিতে আমি আর যুগান্তর দলের আরও কিছু সক্রিয় কর্মী দুপুর ১২টার সময় ওখানে উপস্থিত হলাম। ঐ দিনের লড়াইয়ে কংগ্রেস ও জনগণের জয় হল। সরকার পক্ষ বলপ্রয়োগ করল, এমনকি অবিচ্ছিন্নভাবে গুলি চালাল, গুলিতে একজন নিহত আর শতাধিক আহত হল, কিন্তু তা সত্ত্বেও গুদাম ঘর থেকে এক ছটাক গাঁজা বা মদ বার করতে পারল না। উপরন্তু কংগ্রেস ও জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধে ভয় পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সশস্ত্র পুলিশি প্রহরায় ঐ গুদাম ঘরের সুরক্ষিত ঘরের ভেতর আশ্রয় নিলেন। এই ঘটনার জের স্বরূপ আমার ও কিছু কংগ্রেস কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোল। এর ফলে আমাকে আত্মগোপন করতে হল। এই অবস্থানে ১৯৩০-এর অক্টোবর মাসে একদিন আমি আর যুগান্তর দলের কয়েকজন সক্রিয় কর্মী যখন জামালপুর হয়ে শেরপুর শহরে যাচ্ছিলাম পুলিশ আমাদেরকে গ্রেপ্তার করার জন্য জামালপুর ফেরিঘাট ঘিরে ফেলল। এখানে পুলিশের সাথে আমাদের একটা খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেল। আমরা পুলিশের বেষ্টনী ভাঙ্গার জন্য গুলি চালালাম। পুলিশ আমাদেরকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হল। কিন্তু ঐ বছরই নভেম্বরের ৩০ তারিখে আমি আর যুগান্তর দলের আর এক কর্মী এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নগেন দেব ময়মনসিংহ শহরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলাম। জামালপুরে এক বিশেষ আদালতে আমাদের বিচার হল এবং আমরা ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলাম। প্রথমে জামালপুর সাব জেলে রাখা হলেও পরে আমাকে ময়মনসিংহ জেলা জেলে আবার সেখান থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি করা হল এবং সব শেষে আমাকে আন্দামানে সেলুলার জেলে নির্বাসন দেয়া হয়। সেলুলার জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন আমি মার্কস ও লেনিনের ওপর পড়াশুনা করেই সময় কাটালাম। এবং ক্রমশ আমি মনে প্রাণে একজন কমিউনিস্ট হয়ে উঠলাম। ১৯৩৮-এর মার্চে আমার শাস্তির মেয়াদ ফুরোলে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমি আমার নিজের জেলা শহর ময়মনসিংহে তৎকালীন কমিউনিস্ট কর্মীদের সাথে যোগ দিয়ে একজন কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি এবং ঐ বছরই মে-জুন মাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৩৪ সালের ভারত সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধই ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ও নেতাদের গ্রেপ্তার করতেন না। আমরাও এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমার জেলা কৃষকদের মধ্যে কাজ করে যেতে লাগলাম। কিন্তু ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নাৎসী জার্মানী পোলান্ড আক্রমণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘোষণায় সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে গেল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স মিলিতভাবে এই আক্রমণের নিন্দা করল এবং জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তরফে এক ঘোষণায় এই যুদ্ধ পৃথিবীকে দু’ভাগে ভাগ করার উদ্দেশ্যে দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হল এবং পার্টির স্লোগান হল যুদ্ধের তরে ‘নয় এক পাই, নয় এক ভাই’। ফলস্বরূপ ভারত সরকার কমিউনিস্টদেরকে গ্রেপ্তার করার এক আদেশ জারি করলেন। সুতরাং আমি ও আমার বহু কমিউনিস্ট সহকর্মীকে আত্মগোপন করতে হল। কিন্তু ১৯৪১ সালের ২১ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নাৎসী জার্মানির বর্বরোচিত আক্রমণে পরিস্থিতির আবার এক পরিবর্তন ঘটল। সোভিয়েত ইউনিয়নও জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল এবং নাৎসী জার্মানিকে পরাজিত করার জন্য সমগ্র বিশ্বের কাছে আবেদন করল। এতদিন যে যুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধ তা পরিণত হল জনযুদ্ধে। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টিও তার যুদ্ধবিরোধী নীতির পরিবর্তে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ নেয়ার নীতি অবলম্বন করল। এই সময় ভারত সরকারও কম্যুনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করল। ফলত ১৯৪২ সালে পার্টি বৈধ বলে বিবেচিত হল। এরপরই ১৯৪৩ সালের গোড়ার দিকে অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। ঐ সম্মেলনে আমি পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য তথা প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হই। এ সময়ে ১৯৪৩ এর জুলাইয়ে আমি জুইফুলকে বিয়ে করলাম। উল্লেখ্য যে জুইফুলও পার্টির একজন সর্বসময়ের কর্মী ছিলেন। ১৯৪৫ এর মে মাসে নাৎসী জার্মানির আত্মসমর্পণের সাথে সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। এর পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করল। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতার জিগিরে ভারতীয় উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভাগ করা হল। আমি তখন পাকিস্তানে (পূর্ব পাকিস্তানে) কাজ করতে চাইলাম এবং আমি, আমার স্ত্রী ও দুই বৎসরের শিশুকন্যাসহ ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকাতে আমি প্রায় এক দশক ছিলাম এবং কমিউনিস্ট পার্টির ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞার দরুণ প্রায় এই পুরো দশ বছরই আমাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের অপশাসনের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের জন্মের পর পার্টি বৈধ বলে ঘোষিত হল এবং তারপরই আমরা প্রকাশ্যে কাজকর্ম শুরু করলাম। কিন্তু ১৯৭৫ এর আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং (বাংলাদেশে) এক সামরিক সরকারের ক্ষমতা অধিগ্রহণের ফলে অবস্থার আবার এক বিরাট পরিবর্তন ঘটল। এরপর ১৯৭৬ সালে আমি কলকাতায় চলে আসি এবং সেই থেকে এখানেই বাস করছি।...

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..