
বৃন্দাবন সাহা নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার অধিবাসী ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিও রাজশাহী জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বও মাসে নাটোরের কোরামুদী গ্রামে (বাসুদেবপুর রেল স্টেশনের দুই কি.মি পূর্ব দিকে) জেলা সম্পাদক আজহার শেখের সভাপতিত্বে রাজশাহী জেলা কমিটির সভায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোলে ‘তেভাগা’ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেইমতে জেলার গুরুত্বপূর্ণ কমরেডদের নাচোলে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। পার্টির নিদের্শে কমরেড রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী, চিত্ত চ্যাটার্জী, আজহার শেখ নাচোলে অবস্থান নেন। পার্টির হেড কোয়ার্টারটি ছিল চন্ডিপুরের সুকচাঁদ কর্মকারের বাড়ি। নাচোলে পার্টির প্রধান নেতা ছিলেন চন্ডিপুর গ্রামের মাতলা মাঝি, একজন সাঁওতাল কৃষক। চন্ডিপুর গ্রামকে কেন্দ্র করে আশপাশের বেচেন্দা, জগদ্বল, বিষ্ণুপুর, রাইতারা, পলাশকান্দার, ধরমপুর, কেন্দুয়া, ঘাসুয়া, পলানিয়া, নান্দাই প্রভৃতি গ্রামে বর্গা কৃষকদের ‘তেভাগা’, ক্ষেতমজুরদের ‘সাত আড়ি জিন’ আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়।
১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি সকালে নাচোলে থানার দারোগা তিন জন সিপাহিসহ ঘাসুয়া গ্রামে আসেন লালু গাড়োয়ানের গরুর গাড়িতে। তারা জোতদার প্রফুল্ল বাবুর খোলানে অবস্থান নেয়। সেখানে হেলা এবং বদন মাঝি নামে দুজন আদিবাসী ধান মাড়াই করছিল। দারোগা বাবু আদিবাসী দুজনকে আমগাছের সাথে আড়মোড়া বেঁধে পা থেকে মাথা পর্যন্ত হান্টার মেরে আহত করে। তার সাথে অকথ্য গালিগালাজ করে। কোন এক সময় সুযোগ পেয়ে হেলা মাঝি পালিয়ে চন্ডিপুরে পার্টি অফিসে গিয়ে ঘটনার বিবরণ দেয়।
পুলিশী নির্যাতনের কথা শুনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাদের নিদের্শে চারদিক থেকে লাঠি, বল্লম, তীর, ধনুক ইত্যাদি দেশি অস্ত্র নিয়ে আদিবাসী কৃষকরা ঘাসুয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
তখন পুলিশের দিক থেকে গুলি চালালে কৃষক কর্মীরা মরীয়া হয়ে পুলিশের উপর আক্রমণ করে। তাতে দারোগাসহ চার পুলিশ নিহত হয়। গাড়োয়ান লালু পালিয়ে নাচোল থানায় উপস্থিত হয়ে ঘটনার বিবরণ দেয়।
১৯৫০ সালের ৬ জানুয়ারি সকাল থেকে নাচোলের আন্দোলনরত কৃষকদের উপর সর্বাত্মক পুলিশী হামলা শুরু হয়। গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করতে করতে পুলিশ চন্ডিপুরের দিকে এগোতে থাকে। ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, সম্পদ ফেলে রেখে কৃষকরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। রাত হলে গোপন জায়গা থেকে বেরিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ গ্রাম নান্দাই এর দিকে যাত্রা শুরু করেন বৃন্দাবন সাহা ও ইলা মিত্র। বাকীটা পড়ুন বৃন্দাবন সাহার জবানিতে–
কাছাকাছি যে গ্রাম নিরাপদ, মনে করলাম তার নাম নান্দাই। কিন্তু এতো রাত্রে সে গ্রাম আবিষ্কার করা আমার সাধ্যের বাইরে। কি করবো উপায়হীন অবস্থা! অনেক সাধ্যসাধনা আর বাক্য বিনিময়ের পর কমরেড হরেক সিং-কে আমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে পাওয়া গেল। রাত্রি তখন আনুমানিক সাড়ে আটটা। মহিলা নেত্রী কমরেড ইলা মিত্র, কমরেড হরেক সিং, কমরেড সুখু মাঝি এবং আমি রওয়ানা হলাম। পলাশকান্দরের পশ্চিম দিকের একটি গ্রামে, এক মন্দির প্রাঙ্গণে গিয়ে কমরেড হরেক সিং বসে পড়লো, সে আর যাবে না। কী করি, অগত্যা কমরেড সুখু মাঝির সঙ্গে চললাম।
এখান থেকে প্রায় ৮/৯ মাইলের রাস্তা মুহলবোনা- সেখানে কমরেড সুখুর বাড়ির লোকজন আছে। কমরেড মাতলা মাঝিরও সেখানে থাকার কথা।
এই গ্রামটি নাচোল স্টেশন থেকে উত্তর-পশ্চিমে। আমি বললাম, আমরা এতগুলি লোক! পুলিশ কি করে দেখা যাক না! এখানে এসে আরেকটি ঘটনা ঘটলো, কমরেড ইলা মিত্র ফিট হয়ে গেলেন। অন্যান্য পলাতক লোকজন কেউই আমাদের সঙ্গে ভালভাবে কথা বলছেন না। কমরেড মাতলা মাঝি একসময় আমার সামনে এসে একটু রাগত ভাবেই বললো, ‘আমরা চললাম, আপনারা কি করবেন করেন,’। আমি বললাম, ‘কোথায়’? কমরেড মাতলা মাঝি বললেন, ‘হিন্দুস্তানে’।
সেদিন আমি অনায়াসে এই জনতার সঙ্গে মিশে ইন্ডিয়া চলে যেতে পারতাম। কিন্তু কমরেড ইলা মিত্রের জন্য আমার যাওয়া হলো না। তিনি কিছুতেই নড়বেন না। আমি কি করবো- একাকী এই নারী সঙ্গীটিকে ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাবো! সেটা কী করে হয়!
আমি তাকে বললাম, ‘আমাদের পূর্ব দিকের রেললাইন পার করে দিন, আমরা পূর্বদিকে যাবো,’ কিন্তু কমরেড ইলা মিত্র পূর্ব দিকে যেতে রাজি হলেন না। তিনি যাবেন কলকাতা, কাজেই উত্তর দিকে রহনপুর যেতেই হবে। অগত্যা কি করা যায়, আমি তাতেই রাজি হলাম।
সূর্য কিন্তু রহনপুর পর্যন্ত যেতে রাজি নয়। সে বললো, ‘আমি আপনাদের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে ফিরে আসবো’, আমরা তাতেই রাজি হলাম।
কিছু রাত থাকতেই আমরা উঠে পড়লাম। বেশ জ্যোৎস্নার আলো। পৌষ মাসের শেষ রাতের ঠান্ডা, তাতে আবার উত্তর দিকে চলেছি। গ্রামের ধার দিয়ে রাস্তা। এমনি এক গ্রামে গিয়ে সূর্য মাঝি বিড়ি জ্বালিয়ে আনলেন। অনেক খানি পথ চলে এসেছি, রাত ফর্সা হয়ে এলো, ভোরের পাখিরা কলরব শুরু করেছে। সূর্য উঠতে এখনও অনেক দেরি। এমনি সময় রাস্তার এক বাঁকে এসে, কমরেড সূর্য মাঝি আমাকে বলল ‘হেই রাস্তা দিয়ে চলে যান’, বলে পিছু হটলেন।
এবার আমরা দুটি প্রাণী সম্পূর্ণ অজানা অচেনা পথে চলতে শুরু করলাম। আগে আগে আমি লম্বা ধাপ ফেলে চলেছি, পেছনে কমরেড মিত্র চলছেন আর চলছেন। সূর্য উঠবার আগেই আমার নোট বইখানা পকেট থেকে বের করে মাঠে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। কেন না এই নোট বইখানা অনেক তথ্যবহুল রাজনৈতিক ঘটনায় ভর্তি। কেউ কুড়িয়ে পেয়ে যদি এই নোট বইয়ের মর্মোদ্ধার করতে পারেন, তা হলে আমার লেখা সার্থক হবে।
আমার পায়ে ছিল মোটর টায়ারের স্যান্ডাল। আর কমরেড মিত্রের পায়ে যে স্যান্ডাল ছিল তা রীতিমত ভদ্রোচিত। সেই স্যান্ডালে শিশির লেগে কাদা হয়ে গেছে। স্যান্ডাল পায়ে তিনি হাঁটতেও পারছিলেন না। তাই আমি ওঁকে বুঝিয়ে বললাম, ‘ওগুলো পায়ে দিয়ে তো আপনি ভাল হাঁটতে পারছেন না। ওগুলো খুলে ফেলে দিয়ে খালি পায়ে চলুন।’ তিনি তৎক্ষণাৎ স্যান্ডাল জোড়া খুলে রাস্তায় রেখে খালি পায়ে হাঁটতে লাগলেন।
৭ই জানুয়ারি, ১৯৫০। সূর্য তখন অনেকখানি উঠেছে। শুরু হলো বেনাখড়ের চাড়ার মাঠ। খুব উঁচু উঁচু খড়, নিচু জমি। বিরাট বিল এলাকা। খানিকটা জল-কাদার রাস্তা পার হতে হলো। ঘোষের গ্রামের পর আর রাস্তা পেলাম না। বিলের মধ্য দিয়ে জমির ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা। জমিতে ধান নেই, কেটে নিয়েছে। রাখালেরা গরু চড়াচ্ছে। রাখাল বালকদের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রেললাইন কত দূর?’ হঠাৎ আশার আলো দৃষ্টিগোচর হলো। পূর্ব দিকে রেললাইনের পাতে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে।
অনেক লোকজনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কথা বিশেষ বলছি না, কেবল সকালের গাড়ি ধরতে পারবো কি না জিজ্ঞাসা করছি। সবাই বলছে, ‘হ্যাঁ, ট্রেন ধরতে পারবেন।’ আমরা চলছি উত্তর দিকে। রেললাইনটা আস্তে আস্তে বেঁকে পশ্চিম দিকে চলেছে। আমরাও রেললাইন ধরে পশ্চিম দিকে চলতে লাগলাম। প্রথম সিগন্যাল নজরে পড়লো। লাইনের পাশে ৫/৬ জনের সাথে দেখা হলো। তাঁরা সাধারণ কৃষক। আমি কথাবার্তা বলতে বলতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলাম। তাঁরা কোনো কথাই জিজ্ঞাসা করলেন না। কমরেড মিত্র একটু দূরে আসছিলেন। আমিও আস্তে আস্তে হেঁটে কমরেড মিত্রকে কাছাকাছি সঙ্গ দিলাম।
রহনপুর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উঠলাম। কোনদিন এই স্টেশনে আসি নি। এখানে লাইনটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। আমরা পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে যাচ্ছি। প্রথমেই পাওয়া গেল মেয়েদের বিশ্রামাগার। আমি কমরেড মিত্রকে ইঙ্গিতে সেখানে বসতে বললাম। আমি কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে পুরুষদের বিশ্রামাগার পেলাম। সেখানে কালো লম্বা পোশাক পরিহিত এক যুবককে দেখে, আমার কেমন সন্দেহ হলো। ভাবলাম ইনি নিশ্চয়ই আই.বি’র লোক। আমি বিশ্রামাগারে আর বসলাম না। দক্ষিণ দরজা দিয়ে প্রবেশ করে উত্তর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কাছেই একটা নলকূপ। এই নলকূপে হাত-মুখ ধুয়ে একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেটে ক্ষিদে প্রচুর। কিছু খাওয়া দরকার। তাই চিড়ে-মুড়কি কিনে নিয়ে কমরেড মিত্রের কাছে গেলাম। নারী বিশ্রামাগারে গিয়ে দেখি কমরেড মিত্র সেখানে নেই। আই.বি’র লোকটি আমাদের দিকে প্রখর দৃষ্টি রেখেছে। অজানা জায়গা, লোকজন, রাস্তাঘাট সবই অচেনা। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এলেন। তাঁকে চিড়ে-মুড়কি খাবার জন্য অনেক অনুরোধ করলাম। কিন্তু কিছুতেই রাজি হলেন না। অগত্যা আমি পুরুষ বিশ্রামাগারে ফিরে এলাম। ট্রেন আসতে তখনও অনেক দেরি। তাই খানিক চিড়ে-মুড়কি খেয়ে নিলাম। আই.বি’র লোকটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। যাত্রী বলতে আমরাই দু’জন মাত্র। কোন লোকজন নাই। একটি মাত্র দাড়িওয়ালা লোক স্টেশন চত্বরের পশ্চিম দিক থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্টেশন চত্বরের পূর্বদিকে মুখ ফিরালাম। সেদিকে বেশ কয়েকজনকে দেখলাম। এরা যে সবাই পুলিশের লোক আমার আর বোঝার বাকি থাকলো না। সুতরাং, আমি এবং কমরেড মিত্র দু’জনই শত্রু দ্বারা বেষ্টিত।
কিছুক্ষণ পর লোকজন এসে স্টেশনে জমতে লাগলো। কেননা গাড়ি আসার আর বেশি দেরি নাই। আমি গ্রাম্য সাদা-সিধে লোকের সঙ্গে বসে সাধারণ আলাপ-আলোচনা করতে লাগলাম। গল্প করি আর পুলিশগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখি। হঠাৎ ঘণ্টা বেজে উঠলো। যাত্রীরা টিকিট কেনার জন্য বুকিং অফিস কাউন্টারে লাইন দিলো। আমিও যথারীতি দু’খানা টিকিট কাটলাম। কমরেড মিত্র আগেই বলেছিলেন তিনি কলকাতায় যাবেন, তাই তাঁর জন্য কাটিহারের টিকিট কাটলাম। আমি কাটলাম বুলবুলচন্ডির টিকিট, কেন না আমার উদ্দেশ্য হলো নাচোলের ঘটনার সাথে যেন যোগাযোগ করা যায় এমন জায়গায় গিয়ে থাকা। কমরেড মিত্রকে টিকিট দিতে গেলাম, দেখলাম অনেক গ্রাম্য মেয়ে বসে আছে। তাঁকে ঐসব মেয়েদের সাথে মেয়ে কামরায় উঠতে বললাম। এই টিকিট দেবার সময়ও আই.বি আমাকে অনুসরণ করছিলো। টিকিট দিয়ে আমি সাধারণ লোকের মধ্যে মাটিতে বসে পড়লাম।
যথাসময়ে ট্রেন এলো। অবশ্য নাচোল থেকেই এলো বলতে হবে। স্টেশনে ন্যাশনাল গার্ড আর পুলিশে ভর্তি হয়ে গেল। এদের ‘শুভাগমন’ যে আমাদের পাকড়াও করার জন্য, তা বুঝতে আর অসুবিধা হলো না। ন্যাশনাল গার্ড আর পুলিশরা লাইনের দু’পাশেই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। কিছু পুলিশ গাড়িতে উঠে তল্লাশি শুরু করলো। আমি ট্রেনে উঠবো এমন সময় এক পুলিশ অফিসার হঠাৎ এসে আমার টিকিটখানা চেয়ে নিল। কোনো কথা জিজ্ঞাসা নেই, কেবল টিকিটখানা দেখতে লাগলো। আমি একটু জোর দিয়েই বললাম, ‘টিকিটের কী দেখছেন? ট্রেন ছেড়ে দেবে টিকিটখানা দিন।’ অফিসারটি কোনো উত্তর না করে আমার হাতে টিকিটখানা ফেরত দিয়ে হন্ হন্ করে পূর্বদিকে চলে গেল। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম। বিপদ এসেছে।
আমার সঙ্গে ছিল রক্তমাখা কাপড় চোপড়। ধরা যদি পড়ি, এই রক্তমাখা কাপড়সহ ধরা পড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই তাড়াতাড়ি রক্তমাখা কাপড়গুলি বাঙ্কের উপর রেখে দিয়ে অন্য কামরায় গিয়ে উঠলাম।
আমার পেছনেই মহিলাদের কামরা। এই কামরাতেই কমরেড মিত্র উঠেছেন। কিছুক্ষণ পর পুনরায় সেই অফিসারটিই আমার কাছে ফিরে এলো। আমাকে বললো, ‘আপনাকে নামতে হবে।’ আমি প্রতিবাদ করলাম, ‘কেন নামবো? কী হয়েছে আমাকে বলুন?’ অফিসারটি নাছোড়বান্দা বলে, ‘নামতেই হবে, চটপট শুনে আসুন দেরি হবে না,’ দেখছি লোকটা ছটফট করছে না। আমি দেখলাম খপ্পরে পড়ে গেছি, চিৎকার যতই করি না কেন উপায় নাই। এমনিতে না নামলে, এরা জোর করে নামাবেই। তাই পুনরায় বলে নিলাম ট্রেন ছাড়ার আর কত দেরি? সে বললো, ‘শুনেই চলে আসবেন, বেশি সময় দেরি হবে না’। কী করি! অফিসারটির পিছনে পিছনে পূর্বদিকের পুরুষ বিশ্রামাগারের দিকে চলতে লাগলাম। দূর থেকেই দেখলাম কমরেড মিত্র বিশ্রামাগারের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকেও সেখানে নিয়ে গেল। কমরেড মিত্র এবং আমাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করলো, আমি সেই ঘোষের গ্রামের নাম বললাম। আমার নাম বললাম ‘নগেন্দ্রনাথ ঘোষ’ ‘আমি বুলবুলচন্ডি যাবো।’ কমরেড মিত্রকে দেখিয়ে বললো, ‘ওঁকে চেনেন কি না।’ আমি উত্তর করলাম,’ ‘না, উনাকে চিনি না, কোথায় যাবেন, তাও জানি না। তবে রাস্তায় আসতে দেখেছি।’
একটু দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম কমরেড মিত্র বলছিলেন যে, ‘আমার বাড়ি রামচন্দ্রপুরে, আমার স্বামী নাচোল ছিলেন। আমি শুনতে পেলাম সেখানে নাকি গুলি চলেছে আর আমার স্বামী নাকি মারা গেছেন। স্বামীর কোনো খোঁজ পেলাম না। আমি এখন কলকাতা যাবো।’
আনসার পুলিশরা কতক আমাদের কাছে আর কতকগুলি ট্রেনের ভিতর তল্লাশিতে ব্যস্ত। কারো পোঁটলা, কারো স্যুটকেস ভাঙছে, ছড়াচ্ছে আর তছনছ করছে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। ট্রেন ছেড়ে দেবে, ট্রেনে উঠার কথা বলায়, যে অফিসারটি আমাকে ট্রেন থেকে নামিয়েছিল সে বললো, নাচোল থেকে খবর না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে।
বুঝলাম, আর উপায় নাই। এখন শ্রীঘরে যেতে হবে। তার আগে কত যে নির্যাতন ভোগ করতে হবে, তাও অনুমান করলাম। একজন ল্যান্ড কাস্টম অফিসের পুলিশ আমাদের দু’জনকে নিয়ে গেল তাদের অফিসে। স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে রেললাইনের দক্ষিণ পাশে তাদের অফিস। একটি পুলিশ আমার জামার কলার ধরে নিয়ে যায়। অফিসের সামনে একটি বেঞ্চে আমাকে বসতে দিয়ে, কমরেড মিত্রকে নিয়ে পাশের ঘরে যায়। একজন সিপাই রাইফেল নিয়ে আমাকে পাহারা দিতে লাগলো।
বেলা প্রায় ১২টা। বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। একজন অফিসারকে আমার ক্ষুধার কথা বললাম। সে জানায় ব্যবস্থা হচ্ছে। সামনের টিউবওয়েলে গিয়ে মাথা ধুয়ে ফেললাম। এরপর এলো পুরি আর তরকারি। পেট ভর্তি করেই খেয়ে নিলাম। কেন না, শরীরে দস্তুর মত রসদের দরকার। এরপর যে অবস্থা আমার জন্য অপেক্ষা করছে, তা তো অনুমান করার আর বাকি নাই! তাই সে অবস্থার সম্মুখীন হয়ে এই দেহ খাঁচার অন্তরালস্থ যন্ত্রটাকে চালু রাখা আমার একান্ত কর্তব্য!
খাবার পর ভালভাবে হাত মুখ ধুয়ে আবার বেঞ্চে আশ্রয় নিলাম। কাস্টম অফিসের একজন পাঞ্জাবী সিপাই একজন অফিসারের সঙ্গে গল্প করতে লাগলো। তার বক্তব্য এখানে অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি চলবে না- ইন্ডিয়ায় চলবে।
আমাদের নাচোল নিয়ে যাবার জন্য ফোর্স ডেকেছে। এখন বেলা প্রায় ২টা। ট্রেন আর নাই। সূর্যাস্তের পর ট্রেন। তাই মোটরে নিয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।
লেখক : কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন রাজশাহী জেলা কমিটির সদস্য ও নাচোল কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক
অনুলিখন : আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন