
কমরেড মোকছেদুর রহমান কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা হিসেবেই বেশি পরিচিত। জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার প্রত্যয়, সাহস আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও আপসহীনতার জন্য আপন গরিমায় তিনি ভাস্বর। কমরেড মোকছেদুর রহমান ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি (১৩৩৭ সালে ১৮ পৌষ) পটুয়াখালী জেলার অন্তর্গত বাউফল থানাধীন মধ্য মদনপুরা গ্রামের বড় শিকদার বাড়ি নামক এক বিখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই বাড়ির পরিবারগুলোর শতাধিক বছর ব্যাপী কতগুলো সামন্তবাদী হাওলা ছিল এবং ১৮৮৫ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত জমিদারিও ছিল।
কমরেড মোকছেদুর রহমানের পিতা রজ্জব আলী শিকদার ছিলেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মাতা আকিমন নেছা ছিলেন গৃহিণী। তার মাতা আকিমন নেছার মৃত্যুর পরে তার দ্বিতীয় মাতা জাহানারা বেগম কর্তৃক তিনি লালিত-পালিত ও প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন।
১৯৪৮ সালে ম্যাট্টিক পাসের পর আর্থিক সংকটের কারণে প্রায় ২ বছর তাকে পড়াশুনা বন্ধ রাখতে হয়। বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আই,এ পাস করেন। এরপর তিনি বাউফল থানার অন্তর্গত বগা ইউনিয়ন হাইস্কুলে বছর খানেক শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকাস্থ জগন্নাথ কলেজে বি.এ ভর্তি হন। এ সময় তিনি কমরেড গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক কমরেড অজিত গুহ ও বিজ্ঞানী ড. আঃ খালেকের সংস্পর্শে আসেন। তারা ছিলেন নিষিদ্ধঘোষিত গুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত। কমরেড মোকছেদুর রহমান তাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় কুরিয়ার হিসাবে কাজ করতে লাগলেন।
১৯৫৬ সালে বি.এ পাস করেন তিনি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকে ইউডি ক্লার্ক হিসেবে তার একটা চাকুরি হয়। কিন্তু তার মামা কমরেড দেলোয়ার হোসেনের পরামর্শে ওই চাকুরি না করে তিনি উপজেলা বগা ইউনিয়ন হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
পরে ওই মামা তার নিজ গ্রামে ইন্দুকলে কমরেড গোলাম মোস্তফাসহ গ্রামের অন্য লোকদের সহযোগিতায় একটি স্কুল গড়ে তোলেন। নবগঠিত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হন কমরেড দেলোয়ার হোসেন এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক হন কমরেড মোকছেদুর রহমান। এখানে ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি তার শিক্ষকতার কাজ শুরু হয়। এ স্কুলে ১৯৬২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি কাজ করেন। পরে একই পদে কনকদিয়া হাইস্কুলে ৭ বছর এবং বীরপাশা হাইস্কুলে ২ বছর চাকুরি করেন। বীরপাশা হাইস্কুলে থেকে যান মধ্য মদনপুরা হাইস্কুলে, সেখানে প্রধান শিক্ষক এবং রেক্টর পদে ১৩ বছর চাকুরি করার পরে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণ করলেও তাঁর ঘরে বসে থাকা হয়নি। শিক্ষানুরাগী বেশ ক’জন বেকার যুবক ১৯৯৫ সালে গড়ে তোলে নুরাইনপুর কলেজ। ওই যুবকদের অনুরোধে ইংরেজির অবৈতনিক টিউটর হিসেবে তিনি ২০০২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে আবার কাজ করেন।
১৯৫০ সালে বরিশাল বি.এম কলেজে অধ্যায়নকালে তিনি প্রবীণ নেতা দেবেন ঘোষ পরিচালিত বিপ্লবী সোস্যালিস্ট পার্টির কর্মী কালাচান শর্মা ও তার বোন তুলসী দাসের সংস্পর্শে এসে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন। ১৯৫০ সালে বাউফল থানার একদল সাম্প্রদায়িকতাবাদী নানা ভাবে দাঙ্গার উস্কানি দিতে থাকে। তখন গাজিমাঝি হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক কমরেড দেলোয়ার হোসেনের সাথে একত্র হয়ে দাঙ্গা বন্ধে এগিয়ে যান তিনি। এ সময় তিনি দিনের পর দিন গ্রামে গ্রামে সভা বৈঠক করেন। দেলোয়ার হোসেন ও কমরেড মোকছেদুর রহমান তাঁর কয়েক বন্ধুদেরকে নিয়ে কায়েক মাসব্যাপী তাদের পরিশ্রমই দাঙ্গার আগুন থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। জগন্নাথ কলেজে অধ্যায়নকালে ছাত্র আন্দোলনের সাথে তিনি পাকমার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো, সেন্টো ইত্যাদি সামরিক চুক্তি বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে বাউফল থানাধীন সূর্যমনি ইউনিয়নের তদানীন্তন চেয়ারম্যান ও প্রগতিশীল চিন্তধারার অধিকারী আবদুল আলি বিশ্বাস এর কন্যা রওশন আরা বেগম রেনুকে বিয়ে করেন। এই বিয়েও তার রাজনৈতিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনের পরে ঢাকার রূপমহলে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগের বামপন্থি কর্মীরা মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এই সম্মেলনে কমরেড মোকছেদুর রহমান যোগদান করেন এবং নবগঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাথে যুক্ত হন। ওই বছর তিনি বাউফল থানা ন্যাপ-এর সহ সভাপতি হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাউফল থানার কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান অকস্মাৎ সামরিক শাসন জারি করেন। সরকার ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জেলে ঢুকাতে থাকে। তখন কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতার আন্দোলনসহ সব রাজনৈতিক আন্দোলন বন্ধ করে দেয়া হয়। কমরেড মোকছেদুর রহমান তখন গুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির ইন্দুকুল শাখার সম্পাদক। এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়েও তিনি কমরেড মুকুল সেনের সহযোগিতায় নানা কৌশলে পার্টির কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন।
এর মধ্যে ন্যাপ নেতা সৈয়দ আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে বাউফলে একটা সাংস্কৃতিক সম্মেলন (মূলত রাজনৈতিক সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনকে সফল করার জন্য বিপ্লবী নেতা কমরেড আবদুস সহিদ, সৈয়দ আহমেদ, বজলুল করিম ও কমরেড মোকছেদুর রহমান সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। ওই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল, সাহিত্যিক, রণেশ দাস গুপ্ত, মনোরমা বসু (মাসিমা), প্রখ্যাত আইনবিদ ও সাহিত্যিক বিডি হাবিবুল্লাহ, তদানীন্তন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন ও এ.কে বদরুল হক প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে বাউফলের কেশবপুরাতে তার নেতৃত্বে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে আসার পথে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাতেম আলী খান। সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে যোগদান করেন সৈয়দ আশরাফ হোসেন, বিপ্লবী নেতা কমরেড আবদুস সহিদ ও কুমুদ বিহারী ঠাকুরতা।
বাউফলে কমরেড মোকছেদুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল হাট-ইজারা বিরোধী আন্দোলন ও বর্গাচাষির পক্ষে তেভাগা আন্দোলন। বিভিন্ন আন্দোলনে কমরেড মোকছেদুর রহমানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কারণে ১৯৬৮ সালে তাকে গুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির পটুয়াখালী জেলা সম্মেলনে তিনি জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে জেলা সম্মেলনে কমরেড মোকছেদুর রহমানকে আবার জেলা সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি জেলা কমিটির সভাপতি ও জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কৃষক সমিতিতে তিনি ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৩ সালের সম্মেলনের আগ পর্যন্ত জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৮ সালের সম্মেলন থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সম্মেলনেই তিনি জেলা কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি জেলা কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পটুয়াখালী জেলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন পরিচালিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাউফল ও বাকেরগঞ্জ এলাকায় জাফর-বারেক বাহিনীতে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দৈনিক সংবাদ এর স্থানীয় রিপোর্টার হিসেবে গররিব ও নিঃস্ব মানুষের নানা সমস্যার চিত্র সংবাদ এর পাতায় তুলে ধরেছেন।
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিনি সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানিতে ছিলেন। এ সময়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। তার বিশ্বাস, বিশ্বের দেশে দেশে একদিন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবেই। তিনি বিশ্বাস করতেন, হাজার হাজার বছর ধরে যারা শোষিত-নিপীড়িত, যারা অজ্ঞতা ও অন্ধ কুসংস্কার যুগ যুগ ধরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছাড়া তাদের মুক্তির কোনো বিকল্প নেই। আর এই প্রত্যয় নিয়েই তিনি এই বৃদ্ধ বয়সেও লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে ছিলেন।
১৯৯৫ সাল থেকেই তিনি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও চক্ষু রোগসহ কতগুলো জটিল রোগে ভুগছেন। বেশ কয়েক বছর যাবত তার একমাত্র কন্যা আফরোজা বেগম তার খাওয়া-পরা ও চিকিৎসার মূল দায়িত্ব পালন করছেন। কমরেড নলিনী দাসের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কমরেড মোকছেদুর রহমান জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কমিউনিস্ট থেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
কমরেড মোকছেদুর রহমান লাল সালাম।