
সরকার পরির্তনে দুনিয়ার সামনে নতুন মডেল হিসেবে বিশ্বমঞ্চে হাজির হয়েছে আরব বসন্ত। এই আরব বসন্ত দুনিয়াব্যাপী বড় ধাক্কা দেয় গত দশকে। যদিও এর আগেও এমন আরব বসন্ত বা ক্লাসিক মন্তব্য কালার রেভুলেশন হিসেবে বিভিন্ন দেশে এরকম আন্দোলন ঘটেছে। এশিয়ায় সম্ভবত বড় কালার রেভুলেশনটি ছিল থাইল্যান্ডে ২০০৬ সালে। লাল শার্ট নামে এই আন্দোলনে থাকসিন সিনাওয়াত্রা পদত্যাগ করেন ও পালিয়ে যান। তবে ২০১০ সালে তিউনিশিয়ার ঘটনাই সম্ভবত বেশি প্রভাবিত করেছে দুনিয়াব্যাপী। ২০১০ সালে তিউনিসিয়া থেকে সূচনা হওয়া এই আন্দোলন তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়ে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ একাধিক আরব দেশে। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন এবং বেকারত্বসহ নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট এই আন্দোলনে সবাইকে আহ্বান জানায়। এই বিদ্রোহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদানটি কাজ করেছে, তা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের সংকট থেকে মুক্তি চেয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় সরকার পতনের লক্ষ্য। রাষ্ট্র ব্যর্থতা কিংবা পুলিশি নজরদারি বা সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে একটা শব্দও সুস্পষ্টভাবে কেউ উচ্চারণ করেনি।
অদ্ভূতভাবে এই রাষ্ট্রগুলো পুলিশি নজরদারির এক সামরিকতন্ত্র দ্বারা চালিত হয়েছে। সেই পুলিশি নজরদারির রাষ্ট্র কাঠামোকে না ভেঙে শুধুমাত্র সরকার পরিবর্তনকেই সবাই বিপ্লব ভেবে জ্ঞান উৎপাদন করে চলেছে। যার চরম ব্যর্থতা হিসেবে সামনে চলে আসে মিশরের ঘটনা। মিশরে হোসনি মোবারকের ত্রিশ বছরের শাসনের অবসানের পর আরব বসন্তের মাধ্যমে যার পরাজয় ঘটে, ক্ষমতায় চলে আসে নগিম মাহফুজের ওপর হামলাকারী সমর্থকেরা। তাদের ক্ষমতায় যুক্ত হওয়ার পুরো ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে চরমপন্থি প্রবণতা রাষ্ট্রকে আরো চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়। যে শাসনের অবসানের জন্য এত বড় আন্দোলন বাস্তবে দেখা গেল পূর্ব ব্যবস্থাকে বহাল রেখে আরো বেশি নজরদারি আরোপ ও মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করার কর্মসূচি সামনে নিয়ে আসে। ফলে আরেক সামরিক শাসক মঞ্চে আবির্ভূত হন।
দক্ষিণ এশিয়ায় মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। তাদের আন্দোলনেও কোন ধরনের লক্ষ্যের কথা বলা হয়নি। রাষ্ট্র সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপ তোলেনি। প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে সমাধানের বক্তব্য উচ্চ করে তুলে ধরা হয়। এতে একটি সাধারণ নির্বাচন দিয়ে অং সান সুচিকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তিনি এসে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিলেও ক্ষমতা স্থায়ী করা যায়নি। সুচিকেও শেষে সামরিক বাহিনী উৎখাত করে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে। সর্বশেষ একটি পরিবর্তন হিসেবে দেখা যায় শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার আন্দোলনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্যে অন্যতম ছিল জাতীয়তাবাদের অবসান, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও চীনের ওপর নির্ভরতা কমানো। যেখানে ২০১৯ সালে বিপুল ভোটে রাজাপাকসে ক্ষমতায় আসে। তাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নামে নির্দিষ্ট বক্তব্য নিয়ে। এটি কালার রেভ্যুলুশনের অংশ হলেও দাবিগুলো যেখানে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে, তাই মানুষ বিভ্রান্ত হয়নি।
গত এক দশকে বিশ্ব রাজনীতির আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে আরব বসন্ত ছিল সবচেয়ে প্রত্যাশাবাহী ও বিতর্কিত এক প্রবাহ। ২০১০ সালে তিউনিসিয়ার এক তরুণের আত্মাহুতির মধ্যদিয়ে যে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রাজনীতিতে, তার শিখা এখনো নিভে যায়নি। অনেকেই তখন ভেবেছিলেন এটি নতুন এক গণজাগরণের সূচনা, স্বৈরশাসনের পতনের সূর্যোদয়। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে দেখা গেল, সেই আন্দোলন ছিল মূলত গন্তব্যহীন এক বিদ্রোহ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই বিদ্রোহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়ে ওঠে তথ্য, গুজব, আবেগ ও প্রতিবাদের বিস্ফোরক প্ল্যাটফর্ম। আর এখানেই এক ভয়াবহ প্রবণতার জন্ম নেয় তথ্য যাচাই না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আন্দোলনে সম্পৃক্ততা। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বরং অনেক চিন্তাশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিও এই প্রবাহে ভেসে যান।
বাংলাদেশে আরব বসন্তের ঢেউ হিসেবে যে আন্দোলন হয় সেখানে দেখা যায় রাষ্ট্র ও বিরোধীপক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানো হয়। বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক যখন দেখা যায়, এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সমাজের অনেক চিন্তাশীল, শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ মানুষ, যারা ন্যায্য পরিবর্তনের পক্ষপাতি হলেও, যাচাই না করেই গুজবের ওপর নির্ভর করেছেন। আন্দোলনের ভাষ্য ছিল অস্পষ্ট, কীভাবে রাষ্ট্র পুনর্গঠন হবে, কোন আদর্শে পরিচালিত হবে, কী ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এসব প্রশ্নের কোন সুস্পষ্ট উত্তর মেলেনি। এমনকি আন্দোলনের সময় বলা হয়েছে বৈষম্য দূরীকরণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র আমরা চাই। এর সুস্পষ্ট অর্থ হলো, আওয়ামী রেজিমে বৈষম্য ছিল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ছিল না। এই আলাপ সুস্পষ্ট ভাবে বিভ্রান্তিকর। আমাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে পাহাড়ে বৈষম্য, মৌলবাদী চাপে নারী অধিকার রহিত। পাহাড় ও আদিবাসী বিষয়ে মৌলবাদের অবস্থান ভয়ানক রকম বৈষম্যমূলক। আন্দোলনের সময় এই আলাপগুলো কোনোভাবেই স্পষ্ট করা হয়নি। সম্ভবত শুধু সরকার পতনের অভিপ্রায় থেকে এসব আলাপ তোলা হয়নি। কয়েকটি দেয়াল চিত্রকে আন্দোলনের অভিপ্রায় হিসেবে প্রচার চরম রকম ঘাটতি বহন করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলনের বড় সমর্থক গোষ্ঠী রাষ্ট্র সম্পর্কে পুরোপুরি বিভ্রান্ত একদল মানুষ। যারা রাষ্ট্র সরকার দুটিকে আলাদা অস্তিত্ব হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অদ্ভূত গল্পের অবতারণা করে। যে গল্পের ওপর তারা জোর দেয় সেটা না রাষ্ট্র না সরকার। সেটাকে বড়জোর পাড়ার ক্লাব ঘর হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিভাবে বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে তার একটি ছোট্ট উদাহরণ হিসেবে এই ঘটনাটিকে উল্লেখ করছি। গত ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফকে গ্রেফতার করা হয়। নারী শিক্ষার্থীর অভিযোগ ওই ব্যক্তি অ্যাগ্রেসিভলি জানতে চান- ড্রেস ঠিক কেন নেই, পর্দা কেন করিনি।
এই ঘটনার পর আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে বিবেচনা করা যায় এমন এক বন্ধু লিখেছেন, মোস্তফা আসিফকে যেন চাকরিচ্যুত করা না হয় এবং তার এই কর্মকাণ্ডকে লঘু পাপ হিসেবে বিবেচনা করে গুরুদণ্ড দেওয়া না হয়। পরের দিন এই আসিফের একটি মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেটি থানার হাজতের মধ্যে তিনি কাউকে বলেছেন। এরপর ওই রাজনৈতিক সহকর্মী বন্ধু তার আগের বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। দুটি ঘটনাই চরম ভাবে বিভ্রান্তিকর। তিনি আরোপিত হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সস্তা বিচারিক চিন্তার প্রবৃত্তি থেকে। দুই সিদ্ধান্তই তিনি নিজের বিবেচনাকে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে মোস্তফা আসিফকে আদালত জামিন দেয় ও মামলা প্রত্যাহার করা হয়। তার কারণ প্রথম মন্তব্যের সমর্থকেরা বিপুল বিক্রমে সক্রিয় থাকায়। যা সম্ভব করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৈষম্য সম্পর্কে নারী-পুরুষের আলাদা জগৎকে (ঘর-বাহির) নির্ধারণ করাই বৈষম্যহীনতা হিসেবে প্রচারের গল্প।
আরব বসন্ত আমাদের একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় গণআন্দোলন যদি গুজবনির্ভর হয়, তবে তা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না। বরং তা সৃষ্টি করে অনিশ্চয়তা, বিশৃঙ্খলা ও শূন্যতা। বাংলাদেশকে এই ভুলের চক্র থেকে বের হতে হলে প্রয়োজন দায়িত্বশীল চিন্তাশীল সমাজের নেতৃত্ব। গণতন্ত্র মানে জবাবদিহিতা, তথ্যের সত্যতা, এবং নেতৃত্বের সততা। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এই আন্দোলনের সংগঠক, প্রচারক ও গতিমুখ নির্ধারক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যে গতিতে তথ্য ছড়ানো সম্ভব হয়েছে এই মাধ্যমে, তা অতীতে কখনো সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই গতিশীলতাই প্রশ্ন তুলেছে এই বিপ্লব কি সত্যিকার অর্থে জনগণের মুক্তি এনেছে, নাকি শুধুই একটি শাসকের জায়গায় আরেক শাসকের আবির্ভাব ঘটিয়েছে? নাকি ক্ষণস্থায়ী আবেগের বশবর্তী হয়ে একধরনের শোরগোল সৃষ্টি করেই নিঃশেষ হয়ে গেছে?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক