নারীমুক্তি আন্দোলন ও কমিউনিস্টরা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
হায়দার আকবর খান রনো : আদিম শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে কেনো বৈষম্য ছিল না। সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। ব্যক্তি সম্পত্তি এবং শ্রেণি ও শ্রেণি শোষণ উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উদ্ভব এবং নারী হল শৃঙ্খলিত। এটাকেই ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছেন- নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়। এঙ্গেলস তাঁর বিখ্যাত ‘পরিকর ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উদ্ভব’ গ্রন্থে এই ঐতিহাসিক কালপর্বটি বিষদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; নৃবিজ্ঞানের ভাণ্ডারে অবরন্য সম্পদ হিসাবে যা এখনো বর্তমান রয়েছে। পরবর্তী সবকটি শ্রেণি শোষণের যুগেই নারী পুরুষের অধীন থেকেছে এবং নানাভাবে নিপীড়িত ও শোষিত হয়েছে। সামন্তযুগে নারীকে ঘরের মধ্যেই আটকে রাখা হতো। সামাজিক উৎপাদনে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। যদিও ঘরের সমস্ত কাজও করতে হতো, তবুও এই দৈহিক শ্রমের কোনো সামাজিক মূল্য ছিল না। নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন ঘরের মধ্যে থেকে বিনা পারিশ্রমিকে এই ধরনের কঠোর পরিশ্রমকে সামাজিক উৎপাদনের অংশ বলে ঘোষণা করেছিলেন। পুঁজিবাদী যুগেই নারীরা প্রথম ঘরের বাইরে এল এবং বাইরের উৎপাদনের কাজে যুক্ত হলো। বুর্জোয়ারা নিজেদের প্রয়োজনেই নারী এবং শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করল। প্রথমত বস্ত্রশিল্পে নারীদের উপযোগিতা বেশি ছিল। দ্বিতীয়ত সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থার কারণে তাদেরকে তুলনামূলক কম মজুরি দেয়া চলত। কার্ল মার্কস তাঁর দাস ক্যাপিটাল গ্রন্থে বলেছেন, “পুঁজিপতির জন্য বাধ্যতামূলক কাজ কেবল শিশুদের খেলাধুলার স্থানই দখল করে নিল না, সেই সঙ্গে দখল করে নিল মোটামুটি মাত্রার মধ্যে পরিবার প্রতিপালনের জন্য বাড়িতে স্বাধীন শ্রমের যে স্থান, সেই স্থানটিকেও।” (প্রথম খণ্ড, মস্কো, ইংরেজি ১৯৬১,পৃ. ৩৯৪) পুঁজিবাদী সমাজে নারীর কার্যক্রম ঘরের বাইরে চলে আসলেও নারী পুরুষের সমতা অর্জিত হয়নি। এ কথা সত্য যে নারী উপার্জন করার কারণে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে সক্ষম হয়েছিল তবুও পরিবার, স্বামী বা পুরুষের আধিপত্য রয়েই গেলো। নারী এখন দ্বিবিধ শোষণের শিকার হল। পুঁজিপতির শোষণ এবং পরিবারের অভ্যন্তরে গৃহস্বামীর শোষণ; শ্রেণি শোষণ এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবহার শোষণ। এছাড়া যৌন নিপীড়নের ব্যাপারটিও অপ্রাসঙ্গিক নয়। এঙ্গেলস্ লিখেছেন (উপরোক্ত গ্রন্থে) “প্রভু (পুঁজিপতি) যদি যথেষ্ট নীচু প্রবৃত্তির হয়, তা হলে তার কারখানাটাকে একটা হারেম বলা যেতে পারে। যদি সকল মালিক তার ক্ষমতা প্রয়োগ নাও করে তাতেও নারীর অবস্থান বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না।” এমনকি পরিবারের মধ্যেও নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আধুনিক পুঁজিবাদী যুগেও স্বামী তার স্ত্রীর দেহ মন সবকিছুরই একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করে। সেখানে নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার সামান্যতম কোন মূল্য নাই। রবীন্দ্রনাথ এই বিংশ শতাব্দীতেও স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর বলপূর্বক দেহভোগকে অন্যায় বলে দেখিয়েছেন তার বিখ্যাত ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে। সেখানে তিনি বলছেন তাঁর নায়িকা কুমুদিনী বিক্রি হয়ে গেল, “দাসীর হাটে........ যে হাটে মাছ মাংসের দরে মেয়ে বিক্রি হয়।” নারীর দাসত্বের বিষয়টি লেনিন আরো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, “মজুরি দাসত্ব যতদিন থাকবে ততদিন অনিবার্যভাবে গণিকাবৃত্তি থাকবে” (রচনা সংকলন, খণ্ড ২৩, পৃ. ১৩৭)। আরও পরে ১৯২১ সালে লেনিন দ্বিবিধ শোষণ সম্পর্কে আরো স্পষ্ট করে বলেছেন “.... মানবজাতির নারী অধিকাংশটা পুঁজিবাদের আমলে দুই গুণ পীড়নে পীড়িত। নারী শ্রমিক ও কৃষাণীরা পুঁজির হাতে নিপীড়িত, তদুপরি, এমনকি বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রগুলির সবচেয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেও তারা থেকে যায়, প্রথমত, পূর্ণাধিকারহীন হয়ে, কারণ আইন তাদের পুরুষের সঙ্গে সমতা দেয় না, দ্বিতীয়, এবং আইটে প্রধান কথা, সবচেয়ে তুচ্ছ, সবচেয়ে হীন, সবচেয়ে হাড়ভাঙা, সবচেয়ে বিমূঢ় করা রান্নাবান্নার কাজ এবং সাধারণভাবে একঘেয়ে সাংসারিক ঘরকন্নায় পীড়িত হওয়ায় তারা থেকে যায় ‘ঘরোয়া দাসত্বে’ ‘সংসারিক বাদী’ হয়ে।” (রচনা সংকলন, খণ্ড ৩২, মস্কো, ইংরেজি সংস্করণ, পৃ. ১৩৮) মাও সে তুং চীনা সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নারীর উপর দ্বিবিধ শোষণের পাশাপাশি ধর্মীয় কর্তৃত্বের শোষণের কথাও উল্লেখ করেছিল (হসানের কৃষক আন্দোলনের উপর তদন্ত রিপোর্ট)। ধর্মীয় কর্তৃত্ব সামাজিকভাবে খুবই দৃঢ় এবং তা নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক। এমনকি অক্টোবর বিপ্লবের পরও বহুদিন পর্যন্ত রাশিয়ার নারীরা ধর্মীয় ও ছিল। স্ত্রীদেরকে বাদী বলা হত। লেনিন এর বিরুদ্ধে বিপ্লবের পরও নারীদের সংগঠিত করেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেনিন একদিকে বলছেন, “ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অসাধারণ সতর্ক হওয়া চাই। এ সংগ্রামে যারা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে তারা অনেক ক্ষতি করে”। আবার একই সঙ্গে একই রচনায় তিনি বলছেন, “ধর্মীয় কুসংস্কারের গভীরতম উৎস হল দারিদ্র্য ও তমসাচ্ছন্নতা; এই অভিযানের সঙ্গে আমাদের লড়তে হবেই।” (রচনা সংকলন, খণ্ড ২৮, পৃ. ১৬২)।যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক নীতিসমূহ এবং ধর্মীয় বিষয়গুলি নারীকে পদানত রাখতে সাহায্য করেছে। যেমন ধরুন স্বামী কথাটির মধ্যেই প্রভুত্বের ইঙ্গিত রয়েছে। আধুনিক যুগে অনেক বুর্জোয়া চিন্তাবিদ নারীর মুক্তির প্রসঙ্গটিকে ভালোভাবে নিতে পারেন না। ইউরোপে বণিক বুর্জোয়া বিকাশের যুগে যখন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, বুর্জোয়া মানবিকতা ইত্যাদি বিকাশ লাভ করছিল সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি মহাকবি শেক্সপিয়ার ‘হেমলেট’ নাটকে বলছেন, ‘Frailty they name is women’ উনবিংশ শতাব্দীতে মার্কসের সমসাময়িক পেটিবুর্জোয়া তাত্ত্বিক নেতা পিয়েরে যোসেফ প্রুধো, যিনি বলেছিলেন, “সম্পত্তি মানেই চৌর্য্যবৃত্তি”- তিনিও নারী পুরুষের সমতার বিরোধী ছিলেন। La Pornochcle গ্রন্থে তিনি বলেছেন বিশ্বাসঘাতকতা, অবাধ্যতা, জেদ ইত্যাদি ছয়টি কারণের জন্য স্বামী স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। তার মতে, নারীর বুদ্ধিমত্তা পুরুষের চেয়ে নিম্নস্তরের। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল এবং উনবিংশ শতাব্দীতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চেতনা যারা তুলে ধরেছিলেন তাদের অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্রও বলছেন নারী পুরুষের সমতা সম্ভব নয়। কারণ পুরুষ সন্তান প্রসবও স্তন্যপান করাতে পারে না। নারীকে এই কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। বঙ্কিমের উপন্যাসের নায়িকা দেবী চৌধুরানীর মত মহাবিদ্রোহী ও অনেকটা রবিনহুভের মত জননায়িকা বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার পরিণতি কী হল? জমিদারের স্ত্রী হিসাবে তিন সতীনের সঙ্গে বাসন কোসন মাজা ও ঘর সংসার করার মধ্যেই নারীর জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেলেন। এটা বঙ্কিমেরও দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল ধর্মেই নারীকে পুরুষের অধীনস্ত করে রাখা হয়েছে। শরৎচন্দ্র ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে বলেছেন, “..... যে ধর্ম বুনিয়াদ গড়িয়াছে আদিম জননী ইভের পাপের উপর, যে ধর্ম সংসারের সমস্ত অধঃপতনের মূলে নারীকে বসাইয়া দিয়াছে, সে ধর্মকে সত্য বলিয়া যে কেহ অন্তরে বিশ্বাস করিয়াছে। তাহার সাধ্য নয় নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বাইবেল বলছে নারী হচ্ছে ‘Root of all evil’ ভগবান শংকরাচার্য। স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘নারী হচ্ছে নরকের দ্বার’। একদা হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। মধ্যযুগে ডাইনি বলে ইউরোপে বহু নারীকে পুড়িয়ে মারা হত। এখনো আমাদের দেশে গ্রাম-বাংলায় অনেক অসহায় নারীকে ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে দোররা মারা হয়। অথবা পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। কমিউনিস্টদের দায়িত্ব এই সকল ধর্মের নামে অনাচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়ানো এবং এইক্ষেত্রে সর্বব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলা। কমিউনিস্টরা সব ধরনের অন্যায় অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাই তারা নারী নিপীড়ন ও নারী পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। যদিও কমিউনিস্টরা জানে যে, শ্রেণি শোষণের অবসান না হওয়া পর্যন্ত পরিপূর্ণ নারীমুক্তি সম্ভব নয়। তবুও নারীমুক্তির বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তারা সংগ্রাম করবেন এবং পৃথকভাবে নারী সংগঠন গড়ে তুলবেন। কমিউনিস্টরা জানে যে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ছাড়া মজুরি দাসত্বের অবসান হবে না, তবুও শ্রমিকদের দৈনন্দিন দাবি দাওয়া নিয়ে তারা ট্রেড ইউনিয়ন করেন তেমনই পুঁজিবাদের পরিপূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া নারীমুক্তি সম্ভব না হলেও এই পরিস্থিতির মধ্যেও কমিউনিস্টরা নারী পুরুষের সমান অধিকার ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য সংগ্রাম করবেন। ধর্মীয় আবরণে ও প্রথাগতভাবে যেসকল নারীবিরোধী ও নারী বিদ্বেষী মতবাদ, ভাবধারা ইত্যাদি চালু আছে তার বিরুদ্ধেও আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করবেন অবিচলভাবে। হেফাজত যে ধরনের কথা বলে তা খুবই উলঙ্গ ও সভ্য সমাজে গ্রহণীয় নয়। কিন্তু সভ্যতার আড়ালে এবং ধর্মীয় সংস্কারের আবরণে নারী বিদ্বেষী যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে আমাদের শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় আইনে ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে তার মুখোশ উন্মোচন করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সাহসের সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে। বাংলাদেশে একদিকে ধর্মের নামে সন্ত্রাস, পশ্চাৎপদতা ও নারী বিদ্বেষ যেমন আছে, সমাজে ও পরিবারের মধ্যে স্থূল বা সুক্ষ্মভাবে পুরুষতান্ত্রিকতা ক্রিয়াশীল আছে। অপরদিকে অর্থনৈতিক উৎপাদনে এবং শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান হারে নারীর অংশগ্রহণ, নারীমুক্তির পথকে প্রশস্ত করেছে। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে গার্মেন্টস নারীদের সংগ্রাম খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। চল্লিশ লক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে আশি শতাংশের বেশি কম বয়সী নারী। তারা মালিকদের দ্বারা নির্মমভাবে শোষিত। কমিউনিস্টরা সাধারণভাবে নারী পুরুষের সমতা চাকুরির ক্ষেত্রে সম মজুরি, উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সম অধিকার (মৌলবাদীদের আস্ফালনকে অগ্রাহ্য করেই) এইসকল দাবি নিয়ে মধ্যবিত্তসহ শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির নারীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলবে। একই সঙ্গে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে গার্মেন্ট শিল্প তথা গার্মেন্ট শিল্পের নারী ও অন্যান্য শ্রমজীবী নারী লড়াই-সংগ্রামে অধিকতর মনযোগী ও তৎপর হবে। এই লড়াই বাস্তবক্ষেত্রে অধিকতর নারীমুক্তির ক্ষেত্র তৈরি করবে। আমরা লক্ষ্য করেছি গার্মেন্টেসের নারী শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই চরম দারিদ্র্য কষ্টকর জীবন সত্ত্বেও যেভাবে এবং যতটুকু নারী স্বাধীনতা অর্জন করেছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মেয়েরা তার থেকে এখনো অনেক দূরে রয়েছে। নারী শ্রমিকের শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে সামগ্রিক নারীমুক্তির ও সামাজিক পরিবর্তনের যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কমিউনিস্ট কর্মীরা অনুধাবন করবেন বলে আমি আশা রাখি।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..