খাপড়া ওয়ার্ড দিবস : অনশনে আত্মদান

শাহীন রহমান

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

এ দেশের গণতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াই ও হত্যাকাণ্ডে ৭ জন কমিউনিস্ট বিপ্লবীর আত্মদান একটি ঐতিহাসিক স্মারক ঘটনা। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল সংঘটিত এই ঘটনাটি ‘খাপড়া ওয়ার্ড দিবস’ রূপে পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করেছে ইতিহাসে। এ দেশে প্রথম জেল হত্যাকাণ্ড। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষে নানা ধরনের শোষণ-বৈষম্য-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে বহুমুখী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো- তেভাগা, টংক ও নানকার আন্দোলন। আর এসবের নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি। দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা টালবাহানা করে। কৃষক আন্দোলনের উপর হত্যা-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ-দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে। নারীরাও এ থেকে রেহাই পায়নি। পরবর্তীতে খাদ্য ও মজুরি বৃদ্ধিসহ গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে রেল, বস্ত্র ও চা শ্রমিক এবং নিম্নস্তরের সরকারি কর্মচারীরা ১৯৪৯ সালে আন্দোলনে নামে। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র বিপ্লবের রণনীতি গ্রহণ করে। ফলে কমিউনিস্ট আন্দোলনসহ কৃষক-শ্রমিক তথা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের হিংস্র আক্রমণ নেমে আসে। ১৯৪৮-৫০ এই সময়কারে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে প্রায় শতাধিক নেতা-কর্মী শহীদ হন। দেশের কারাগারগুলি ভরে যায় কমিউনিস্ট রাজবন্দীদের দিয়ে। শুধু তাই নয় জেলখানাতেও কমিউনিস্ট রাজবন্দীদের উপর চলে নির্মম অত্যাচার। জেলে প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করা হয় তাদের। জেলে এ ধরনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল-কমিউনিস্টদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন ধ্বংস করা। দেশ ভাগের পূর্বে বৃটিশ আমলে রাজবন্দীরা যে অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত পাকিস্তানী আমলে তার বিলুপ্তি ঘটে। ফলে রাজবন্দীর প্রাপ্য ন্যায্য মর্যাদা, অধিকার, সুযোগ-সুবিধা পুনরুদ্ধার এবং বর্বর নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে বিভিন্ন কারাগারে কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ঢাকা, রাজশাহী সিলেট, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে এই আন্দোলন চলে ১১ মার্চ ১৯৪৯ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৫০ পর্যন্ত। জেলখানায় আন্দোলনরূপে এভাবে কয়েক দফায় ঢাকা (১২৭ দিন), রাজশাহী (১৮৫ দিন), সিলেট (২২ দিন) এবং রংপুর (১৫ দিন) কারাগারে কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা মোট ৩৪৯ দিন অনশন ধর্মঘট করেন। আর এই অনশন ধর্মঘট চলাকালে তাদের উপর ভয়ংকর নির্যাতন করা হয়। ফলে ঢাকা কারাগারে জোরপূর্বক নল দিয়ে খাবার ঢোকানোর জন্য কমরেড শিবেন রায়, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে স্থানান্তরিত মারাত্নক আহত কমরেড ফণী গুহ (তৎকালীন ঢাকা জেলা পার্টির সম্পাদক) এবং খুলনা জেলে কারা পুলিশের নৃশংস নির্যাতনে কমরেড বিষ্ণু বৈরাগীর মৃত্যু ঘটে। ১৯৪৮-৫০ এ সময়কালে কারাগারে নির্মম অত্যাচার এবং বিনা চিকিৎসা ও কুচিকিৎসায় কারাগারেই ৪০ জন কমিউনিস্ট রাজবন্দী মারা যান। এছাড়াও বরিশালে সুশীল দাস, যশোরের কমরেড লুৎফর রহমান ও মোজাম মোল্লা, খুলনার হরসিত মণ্ডলকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে থাকা আমরণ অনশন ধর্মঘটকারী কমিউনিস্ট রাজবন্দীদের উপর হঠাৎ গুলিবর্ষণ ও লাঠিপেটার কারণে ৭ জন মৃত্যু বরণ করেন। মারাত্মক আহত হন ৩২ জন। যথাযথ চিকিৎসা হলে যাদের অনেকেই বেঁচে যেতেন, অনেককেই স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করতে হতো না। এই শহীদ তরুণ কমিউনিস্টরা হলেন- কম্পরাম সিংহ, হানিফ শেখ, আনোয়ার হোসেন, সুধীন ধর, দিলওয়ার হোসেন, সুখেন ভট্টাচার্য ও বিজন সেন। আর আহতদের মধ্যে ছিলেন- সৈয়দ মনসুর হাবিব, আব্দুস শহীদ, আশু ভরদ্বাজ, সত্যেন সরকার, নুরুন্নবী চৌধুরী, প্রিয়ব্রত দাস (মনজু), অনন্ত দেব, ডা. গণেন্দ্র নাথ সরকার, নাসির উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল হক, আমিনুল ইসলাম বাদশা, শচীন্দ্র চক্রবর্তী, সাইমন মণ্ডল, কালীপদ সরকার, অনিমেষ ভট্টাচার্য, বাবর আলী, প্রসাদ রায়, গারিসউল্লাহ সরকার, ভূজেন পালিত, ফটিক রায়, সীতাংশু মৈত্র, সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার, ডোমারাম সিংহ, সত্যরঞ্জন ভট্টচার্য, লালু পান্ডে, মাধব দত্ত, খবীর শেখ, আভরণ সিংহ, সুধীর সান্যাল, শ্যামাপদ সেন, পরিতোষ দাশগুপ্ত ও হীরেন সেন। খাপড়া ওয়ার্ড হল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের জন্য নির্দিষ্ট টালির বা মাটির খাপড়ার ছাদ বিশিষ্ট বিরাট আটচালা ঘর। মাটির খাপড়া বা টালি দিয়ে ছাউনির কারণে এর নাম হয় ‘খাপড়া ওয়ার্ড’। সেদিন খাপড়া ওয়ার্ডের ঘটনার সময় এর ভেতরে রাজবন্দীদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সবাই একমত এই সংখ্যা কমপক্ষে ৩৯ জন। খাপড়া ওয়ার্ডের বীরোচিত লড়াই, হত্যাকাণ্ড ও আত্মত্যাগের এই ঐতিহাসিক ঘটনা কিন্তু তখন দেশের জগণকে জানতে দেওয়া হয়নি। ফলে তেমন প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি। এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ এই মর্মান্তিক ঘটনার খবর পায় ৭ দিন পর। এপ্রিলের (১৯৫০) শেষ দিকে কেবল সরকারি বানোয়াট প্রেসনোটে বলা হয় রাজশাহী জেলে পুলিশের রাইফেল কিছু কয়েদী ছিনতাই করতে গেলে পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়লে কয়েকজন কয়েদীর মৃত্যু হয় এবং আহত হন কয়েক জন। পরবর্তীকালে অবশ্য এই ঘটনা আর চাপা থাকেনি। ১৯৫১ সাল থেকে প্রতি বছর কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃবৃন্দ তাদের গোপন আশ্রয়স্থলে এ দিনটি পালন শুরু করে। ঢাকাসহ বিভিন্ন কারাগারেও খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদদের স্মরণে সভা করা হতো। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পর খাপড়া ওয়ার্ডের বর্বর হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। বিশেষত ৫৪’ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসায় পূর্ব বাংলার জনগণ এই দিনটির তাৎপর্য অনুধাবনের সুযোগ পায়। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের দাবি জানান। পরবর্তীতে বিভিন্ন সংগঠন প্রবলভাবে ২৪ এপ্রিল শহীদ দিবসরূপে পালনের দাবি তোলে। সংবাদসহ নানা পত্র-পত্রিকায় খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা পকাশ পায়। ১৯৬১ সালের ১৮ এপ্রিল কমিউনিস্ট পার্টির গোপন পত্রিকা ‘শিখা’ খাপড়া ওয়ার্ড দিবস স্মরণে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ‘খাপড়া ওয়ার্ড দিবস’ ঘটনাটিকে পুনরায় জোরালোভাবে সামনে উঠে আসে। ১৯৬২ সালের ২৪ এপ্রিল তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এই দিনটিকে ‘শহীদ দিবস’ পালনের আহ্বান জানায়। অনিল মুখার্জী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, মণি সিংহ, সরদার ফজলুল করিম, আবদুস শহীদ, সন্তোষ গুপ্ত, বদরুউদ্দীন উপর প্রমুখ সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব তাদের লেখায় ‘খাপড়া ওয়ার্ড দিবস’ এর স্মৃতি চিরজাগরুক করে রাখে। দেশ স্বাধীনের পর এ যাবৎ পর্যন্ত সাপ্তাহিক একতা পত্রিকায় ‘খাপড়া ওয়ার্ড দিবস’ স্মরণে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকাগুলিতেও এখন এ দিবসটি স্মরণ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তৎকালীন সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সরকার খাপড়া ওয়ার্ড শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের আবেদন জানান। এর ফলে খাপড়া ওয়ার্ডের সাত শহীদের নামফলকসহ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং কমরেড মণি সিংহ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে এই দিবসটি পালিত হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৫১ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা খাপড়া ওয়ার্ড দিবসকে স্মরণ করার জন্য কলকাতায় ‘পাকিস্তানী শহীদ স্মৃতি কমিটি’ গঠন করে। অগ্নিযুগের বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট নেতা সতীশ পাকড়াশী এর সভাপতি হন। এই কমিটির উদ্যোগে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ‘খাপড়া ওয়ার্ড দিবস’ যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়েছে। পরবর্তীতে বিভক্তির পরও বিভিন্ন সংগঠন ও তাদের মুখপত্র এই দিনটি স্মরণ করে চলেছে। এদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘খাপড়া ওয়ার্ড দিবস’ এক মহৎ ঐতিহ্য। দেশ ও জনগণের জন্য এই ‘অনশনে আত্মদান’ এর চেতনা তরুণদের মধ্যে সঞ্চারিত করা আজ জরুরি প্রয়োজন। সেজন্য আমরা দাবি জানাই– (১) খাপড়া ওয়ার্ড দিবসকে প্রথম জেল হত্যাকাণ্ডরূপে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানসহ জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। (২) সর্বজনীন অধগতির জন্য এ দিবসের ঘটনা ও তাৎপর্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে (৩) ৭ জন খাপড়া ওয়ার্ড শহীদকে জাতীয় শহীদরুপে স্বীকৃতি দিতে হবে। লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..