মার্কসবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা

টেরি ঈগলটন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

মার্কসবাদ যান্ত্রিক কিংবা তা সবকিছুই অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বিচার করে, এ ধরনের একটা অপবাদ মার্কসবাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়। বিশেষত শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অভিযোগ উঠে। তাই এই লেখাটি সেই সব অভিযোগে খণ্ডনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস মার্কস ও এঙ্গেলস সাহিত্য সম্পর্কিত রচনা অপেক্ষা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রচনার জন্য বেশি পরিচিত হওয়ার কারণ এই নয় যে তাঁরা সাহিত্যকে তুচ্ছ বলে মনে করতেন। লিয়ঁ ট্রটস্কি ‘লিটরেচার অ্যান্ড রিভল্যুশন’ বইতে সত্যকথাই বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে বহু লোক আছে যাদের ভাবনা বিপ্লববাদীদের মতো অথচ অনুভূতি বর্বরের মতো।’ অবশ্য মার্কস ও এঙ্গেলস এই ধরনের লোক ছিলেন না। কার্ল মার্কস, যিনি লিরিক কবিতা লিখতেন, একটি অসমাপ্ত কাব্যনাট্য এবং লরেন্স স্টার্ন-এর দ্বারা প্রভাবিত একটি অসমাপ্ত কমিক উপন্যাস লিখেছিলেন, তাঁর সকল রচনাই সাহিত্যিক ধ্যান-ধারণা এবং অনুষঙ্গ দ্বারা সম্পৃক্ত। তিনি শিল্প ও ধর্মের উপরে একটি দীর্ঘ অপ্রকাশিত রচনা লিখেছিলেন এবং নাট্য সমালোচনার একটি পত্রিকা, বালজাকের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা এবং নন্দনতত্ত্বের উপর একটি রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। ধ্রুপদী জার্মান ঐতিহ্যের ধারক হিসাবে মার্কস ছিলেন অত্যন্ত শিক্ষিত একজন জার্মান বুদ্ধিজীবী এবং শিল্প ও সাহিত্য তাঁর কাছে ছিল শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই অপরিহার্য ও স্বাভাবিক। সফোক্লিস থেকে স্পেনীয় নভেল, লুক্রেশিয়াস্ থেকে সাম্প্রতিক ইংরাজি ফিক্শন– সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচিতির এই পরিধি ছিল বিরাট। তিনি ব্রুসেলসে যে-জার্মান শ্রমিকচক্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটি সপ্তাহের একটি সন্ধ্যায় শিল্পসংক্রান্ত আলোচনা করত এবং মার্কস নিজে ছিলেন একজন অভ্যস্ত থিয়েটার-দর্শক, কবিতা আবৃত্তি করতে ভালবাসতেন এবং অগাস্টান গদ্য থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যালাড– সবরকম সাহিত্যের অনলস পাঠক ছিলেন। তিনি এঙ্গেলসকে লেখা একটি চিঠিতে নিজের রচনাবলীকে বর্ণনা করেছেন– একটি ‘শৈল্পিক সমগ’ বলে এবং লিখনশৈলী, বিশেষত নিজের লেখার শৈলী বিষয়ে ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। সাংবাদিকতার প্রথম প্রবন্ধেই তিনি শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গীর স্বাধীনতার সপক্ষে যুক্তি রাখেন। এমনকি তাঁর প্রবীণ রচনায়, কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভাবনার পেছনেও নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার প্রভাব অনুভূত হয়। এসব সত্ত্বেও একথা ঠিক যে মার্কস ও এঙ্গেলসের হাতে একটি পূর্ণাঙ্গ নন্দনতত্ত্ব গড়ে তোলা ছাড়াও অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। শিল্প ও সাহিত্যের উপরে তাঁদের মন্তব্যগুলি ছড়ানো-ছিটানো ও আংশিক; পরিণত একটি তত্ত্বের বদলে সেগুলি বরং অনুষঙ্গ হিসাবেই এসেছে। এই কারনেই মার্কসীয় সমালোচনার অর্থ কেবলমাত্র মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতাদের বক্তব্যকে পুনরাবৃত্তি করাই নয়, তার দায়িত্ব আরো বেশি। তা ‘সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব’ নামে পাশ্চাত্যে যা পরিচিত হয়েছে, তার থেকেও বেশি কিছু। সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব যেসব বিষয় নিয়ে প্রধানত আলোচনা করে, তা হলো একটি নির্দিষ্ট সমাজে সাহিত্যের উৎপাদন, বণ্টন ও আদানপ্রদানের উপায়; বই প্রকাশনার পদ্ধতি, লেখক ও পাঠকদের সামাজিক গঠন, শিক্ষার মান এবং ‘রুচি’ নির্ধারণের সামাজিক কারণসমূহ। এছাড়া সাহিত্যকর্মের ‘সমাজতাত্ত্বিক’ উপাদানকে পরীক্ষা করা, তার মধ্যে থেকে সমাজ-ঐতিহাসিকের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহকে বের করে আনাও এর কাজ। এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু চমৎকার কাজ হয়েছে এবং একে মার্কসীয় সমালোচনার একটি অঙ্গ বলা যেতে পারে; কিন্তু তা নিজে ঠিক মার্কসীয়ও নয়, বা ঠিক সমালোচনা ও নয়। আসলে তা পাশ্চাত্যের জন্য উপযুক্ত মার্কসীয় সমালোচনার এক ধারহীন মৃদু রূপ। মার্কসীয় সমালোচনা কেবলমাত্র একটা ‘সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব’ নয়, যা কী করে উপন্যাস প্রকাশিত হয় এবং সেগুলিতে শ্রমিকশ্রেণির উল্লেখ আছে কিনা তাই আলোচনা করে। সাহিত্যকর্মকে আরো পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করাই তার লক্ষ্য, এবং তার জন্য তা আঙ্গিক, শৈলী এবং অর্থের প্রতি আরো সচেতন মনোনিবেশ দাবি করে। কিন্তু শুধু তাই নয়, সাহিত্যকর্মের আঙ্গিক, শৈলী ও অর্থকে তা একটি নির্দিষ্ট ইতিহাসের ফল হিসাবে উপলব্ধি করতে চায়। চিত্রশিল্পী আঁরি মাতিস একবার মন্তব্য করেছিলেন যে সমস্ত শিল্পকর্মেই এটাও বোঝা যায় যে কেন ওই প্লাসিদো উপসাগরের দৃশ্যটি শৈল্পিকভাবে রসোত্তীর্ণ হয়েছে। ভালো লেখা শুধুমাত্র শৈলীর ব্যাপার নয়, তার জন্য এক মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গী লেখকের থাকা দরকার, যার সাহায্যে কোন এক পরিস্থিতিতে মানুষের অভিজ্ঞতার সত্যকে লেখক বের করে আনতে পারেন। এবং প্লাসিদো উপসাগরের দৃশ্যে এটা অবশ্যই সম্ভব হয়েছে। তা সম্ভব হয়েছে শুধু লেখকের গদ্যশৈলী উৎকৃষ্ট বলে নয়, সম্ভব হয়েছে এইজন্য যে লেখকের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি তাঁকে এই অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। এই অন্তর্দৃষ্টি রাজনৈতিক অর্থে ‘প্রগতিশীল’ না ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ (কনরাডের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরেরটা) তা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিংশ শতাব্দীর বেশির ভাগ বড় লেখকই– ইয়েট্স, ইলিয়ট, পাউন্ড, লরেন; রাজনৈতিকভাবে সংরক্ষণশীল এবং ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। মার্কসীয় সমালোচনা এর জন্য অনুযোগ না করে একে ব্যাখ্যা করে। এই সত্যকে তা দেখতে পায় যে প্রকৃত বিপ্লবী শিল্পের অবর্তমানে অবক্ষয়ী উদারতাবাদী বুর্জোয়া মূল্যবোধের প্রতি মার্কসবাদের মতো শত্রুভাবাপন্ন এক র্যা ডিকাল সংরক্ষণশীলতাই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্যের জন্ম দিতে পারে। একথা ভাবা ভুল হবে যে মার্কসীয় সমালোচনা কেবল যান্ত্রিকভাবে ‘পাঠ’ (text) থেকে ‘মতাদর্শ’, সেখান থেকে ‘সামাজিক সম্পর্ক’ ও ‘সামাজিক সম্পর্ক’ থেকে ‘উৎপাদক শক্তি’র মধ্যে ঘোরাফেরা করে। বরং তা সমাজের এই বিভিন্ন স্তরের ঐক্য নিয়ে ভাবে। সাহিত্য উপরিসৌধের অংশ হতে পারে, কিন্তু তা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভিত্তির নিষ্ক্রিয় প্রতিফলন নয়। ১৮৯০ সালে জোসেফ ব্লখ্-কে লেখা এক চিঠিতে এঙ্গেলস এই কথাটি পরিষ্কার করে বলেছেন– ‘ইতিহাসের জড়বাদী ধারণা অনুযায়ী ইতিহাসে চরম নির্ধারক উপাদানটি হলো বাস্তব জীবনে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন। মার্কস বা আমি, কেউই এর থেকে বেশি কিছু বলিনি। তাই যদি কেউ এই বক্তব্যকে মোচড় দিয়ে বলে যে অর্থনৈতিক উপাদানটিই একমাত্র নির্ধারক উপাদান তাহলে সে কথাটিকে একটি অর্থহীন, বিমূর্ত ও অদ্ভুত বাক্যে পরিণত করে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হলো ভিত্তি, কিন্তু উপরিসৌধের বিভিন্ন উপাদানগুলি, যেমন শ্রেণিসংগ্রামের রাজনৈতিক কর্মগুলি ও তার ফলাফল, যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর বিজয়ী শ্রেণির প্রবর্তিত সংবিধান ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের আইন– এমনকি যোদ্ধাদের মস্তিষ্কে এই সমস্ত বাস্তব সংগ্রামের প্রতিক্রিয়া, যেমন রাজনৈতিক, আইনগত এবং দার্শনিক বিভিন্ন তত্ত্ব, বিভিন্ন ধর্মীয় ভাবনা এবং পরে সেগুলির সংস্কারের বেড়াজালে রূপান্তর– এইসবও ঐতিহাসিক সংগ্রামের গতিপথকে প্রভাবিত করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের রূপ কী হবে তার নির্ধারণে এইগুলিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়। লেখক : বিখ্যাত ব্রিটিশ মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ববিদ

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..