ভারতের আসন্ন নির্বাচনে কেন চাই বামপন্থিদের

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

সামনে ভারতের নির্বাচন। দেশকে বাঁচতে চিন্তা এবং তৎপরতা দুই দুটো ক্ষেত্রে লড়াইয়ে নেমেছে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা। সংসদে বামপন্থিদের সংখ্যা কমলেও প্রভাব বাড়ছে। কারণ নির্বাচনী যুদ্ধে বামপন্থিদের বিজয় মানেই মেহনতি ও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা। সেই প্রেক্ষাপট নিয়েই এই লেখা ঠিক দু’দশক আগের লোকসভা নির্বাচন। ২০০৪ সালের সেই গ্রীষ্মের রঙ ছিল লাল। বামপন্থিরা ৬১। বামপন্থিদের ছাড়া সেদিন নতুন সরকার গঠন ছিল অসম্ভব। শেয়ার বাজারে বেনজির ধস। আতঙ্কে মিডিয়া। বামপন্থিদের সেই জয়ে মিডিয়া দেখেছিল ‘রাস্তায় রক্তস্নান’। মন্ত্রিত্ব নয়। সেদিন শুরুতেই বিলগ্নীকরণ মন্ত্রক তুলে দিতে বলেছিলেন হরকিষাণ সিং সুরজিৎ। অর্ধেন্দু ভূষণ বর্ধন বলেছিলেন ‘ভাড় মে যায়ে উয়ো মন্ত্রক (বিলগ্নীকরণ), আওর উনকা মন্ত্রী (অরুণ শৌরি)।’ জাহান্নামে যাক ওই মন্ত্রক, আর তার মন্ত্রী। ভেইল, নালকো, নেভেলি লিগনাইট। বিলগ্নী করতে নেমেও শেষে গুটিয়ে যায় কেন্দ্র। কারন, সেদিন সরকার ছিল বামপন্থিদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। শ্রমিকদের জঙ্গি মেজাজ। ধর্মঘটের শক্ত জমিতে বামপন্থিদের জোরালো প্রতিবাদ। চাপ বাড়াতে সমন্বয় কমিটির বৈঠক বয়কট। সবরকম চেষ্টা চালিয়েও তাই বিলগ্নীকরণ করতে পারেনি। এগোতে পারেনি এক ইঞ্চিও। চাপের মুখে শেষে পিছু হটে সরকার। বামপন্থিদের বয়কটের মুখে ইউপিএ সভানেত্রীর চিঠি। বিক্রি করা হবে না ভেইলের শেয়ার। বিলগ্নী হবে না নবরত্ন সংস্থাগুলিতে। সেদিন সংসদে বামপন্থিরা ৬১। স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ। বামপন্থিরা ৬১ মানে, ক্ষমতার সব সুযোগ, আমন্ত্রণের পরেও ক্ষমতার কুর্সি থেকে দূরে থাকার সততা। একটা দৃষ্টান্ত। নিজের বিশ্বাসের প্রতি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গভীর প্রত্যয়। নীতিনিষ্ঠ অবস্থান থেকেই বাইরে থেকে সমর্থন। দূরে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। সমর্থনের ভিত্তি সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচি। বামপন্থিরা ৬১ মানে, সংসদে আলোচনার অ্যাজেন্ডা বদল। সংসদে আমজনতার কণ্ঠস্বর। সংসদে বিদর্ভ। সংসদে কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি। কৃষিঋণ মওকুফ। স্বামীনাথন কমিশন। নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ। রুগ্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পুনরুজ্জীবন। বামপন্থিরা মানে, একশ দিনের কাজ জোর করে আদায়। দয়ার দান নয়। আইনি অধিকার। প্রস্তাবিত আইনে ছিল কাজ পাবেন শুধু দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষ। বামপন্থিদের চাপে শেষে সংশোধন। সবার জন্য কাজের আইন। শুরুতে চাপ ছিল হোক পাইলট প্রজেক্ট। বামপন্থিদের চাপে শেষে গোটা গ্রাম-ভারতে। বামপন্থিদের দাবি ছিল গ্রামের সঙ্গে শহরের গরিব মানুষের জন্যও চাই একই প্রকল্প। মানানো যায়নি। পুজিবাদী নয়া উদার নীতির পথ পুরোপুরি পরিত্যাগ না করলেও, বামপন্থিদের চাপে সেদিন সরকার নিতে বাধ্য হয় কিছু কল্যাণকর কর্মসূচি। সেই সময়েই বনবাসীদের জন্য অরণ্যের অধিকার আইন। পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইন। তথ্যের অধিকার আইন। বামপন্থিদের চাপেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ড. অর্জুন সেনগুপ্তের নেতৃত্বে কমিশন। বামপন্থিরা মানে অ্যাজেন্ডায় শ্রমিক। অ্যাজেন্ডায় কৃষক। অ্যাজেন্ডায় আমজনতা। বামপন্থিদের কারণেই আটকে যায় খুচরো ব্যাবসায় ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ। বামপন্থিদের জন্যই আটকে থাকে পেটেন্ট আইন সংশোধন। সাম্রাজ্যবাদমুখী নীতি ও নয়া উদার নীতির বিরুদ্ধে একমাত্র বিশ্বস্ত সৈনিক বামপন্থিরা। বামপন্থিরা মানে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হিম্মত। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শেলফে তুলে রাখার বিষয় নয়। কেউ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কেউ ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বিষয়টিকে বেমালুম ভুলে যেতে বলছিলেন। এমনকি কেউ আবার ভুলে যেতে বলছিলেন লেনিনকে। কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখেন না। বিশ্লেষণ করেন ধনতন্ত্রজাত এক সামগ্রিক ব্যবস্থার পরিণতি হিসেবে। ৬১ কেন, একজন সংসদ সদস্য না থাকলেও এই প্রতিবাদে বামপন্থিরা সমান দায়বদ্ধ। কারো কোথাও দ্বিধা থাকলেও, বিলক্ষণ জানে ওয়াশিংটন। আরও জানিয়েছে উইকিলিকসে তথ্য ফাঁস। কোথায় কলকাতা। কোথায় নিউ ইয়র্ক সিটি। ২০১১, রাজ্যে বিধানসভা ভোটের পাক্কা চারমাস আগে বিরোধী নেত্রীকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকায় প্রায় পাতাজোড়া স্যাটার্ডে প্রোফাইল। ১৩৭৬ শব্দের (যেখানে উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে থাকে গড়ে ৮০০-১০০০ শব্দ) প্রতিবেদনের শিরোনাম দ্য আই অব দি ইন্ডিয়ান হ্যারিকেন। দিদি মানে কী থেকে যে ‘ছোট্ট’ কালো গাড়ি তিনি ব্যবহার করতেন, ‘সাধারণ সুতির শাড়ি’ থেকে যে ‘প্লাস্টিকের চপ্পল’ পরেন- তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা। বাংলার কোনো দৈনিকে নয়, মার্কিন দেনিকে। টাইমস সেদিনই আঁচ পেয়ে গিয়েছিল কী করতে হবে। ৬১-কে ধাক্কা মারতে হলে আঘাত হানতে হবে পশ্চিমবঙ্গের ৩৫-এ। দিদির ‘প্রোফাইল’ লিখতে তাই কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন জিম ইয়ার্ডলে। স্বাভাবিক। তার দু’বছর আগেই কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেট থেকে বার্তা গিয়েছিল সিআইএ, মার্কিন বিদেশদপ্তরে। হ্যাঁ, সিআইএ, আর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে। যেমন প্রতিনিয়ত ‘আপডেট’ যায় লাতিন আমেরিকার দেশগুলি থেকে। ফাঁস হওয়া সেই দলিলের শিরোনাম ছিল, ‘তৃণমূলের মমতা ব্যানার্জি: বিরোধিতায় রাস্তার যোদ্ধা থেকে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অপেক্ষায়’। যেখানে বলা হয়েছিল মমতাকে কাল্টিভেট করার কথা। টাইমস তাই নেমে পড়ে কাল্টিভেট করার কাজে। যে কারণে পরে টাইমস লেখে, ‘তিনি (মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর) এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন, যে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিন্টন ভারত সফরে এসে আলাদা করে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন, যা যে কোনো আঞ্চলিক নেতার কাছে বিরাট সম্মানের।’ বাকিরা বুঝে-না বুঝে ভুল করতে পারেন। বামপন্থিদের চিনতে ওয়াশিংটন কখনও ভুলে করেনি, করে না। যেমন করেনি, করে না আরএসএস। এই সেদিনও মোহন ভাগবত নিশানা করেছেন মার্কসবাদীদের। এবারে বিজয়া দশমীতে, নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদরদপ্তরে সরসঙ্ঘচালক ভাগবত ব্যবহার করেছেন নতুন শব্দবন্ধু সাংস্কৃতিক মার্কসবাদী। সঙ্ঘের তাত্ত্বিক নেতা রাম মাধব একধাপ এগিয়ে লিখেছেন, আগামী একবছরে ‘ভারতের জন্য ভাগবতের মন্ত্র’। টার্গেট: মার্কসবাদীরা। দু’দশক বাদে, লোকসভায় বামপন্থিরা সাকুল্যে ৫। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কম। তবু লক্ষ্য বামপন্থিরা। সঙ্ঘের পাঠ্যক্রমে অবশ্য মোটেই নতুন কথা নয়। বাঞ্চ অব থটস-এ গোলওয়ালকার সেই কবে ভারতে তিন প্রধান শত্রুর কথা বলেছিলেন- মুসলিম, খ্রিস্টান আর কমিউনিস্ট। ভাগবত কেবল নতুন শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। বামপন্থি ইকোসিস্টেম-এর কথা বলে ভাগবত আসলে হিন্দুত্বের সার্বিক কর্তৃত্ব হিন্দুত্ব ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। সর্বত্র বামপন্থিদের অনুপ্রবেশ খোঁজার অছিলায় কায়েম করতে চাইছেন সঙ্ঘের রাজ। বামপন্থিরা দুর্বল মানে, দুর্বল আমজনতার রুটিরুজি লড়াই। বামপন্থিরা দুর্বল মানে মেরুকরণের বাড়বাড়ন্ত। বামপন্থিরা দুর্বল মানে গণতন্ত্র থেকে নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র-এর পথে দেশ। বামপন্থিরা দুর্বল মানে ওয়াশিংটনের নির্লজ্জ দালালি। প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে অবস্থান, ইজরায়েলের হয়ে দালালি। বামপন্থিরা যখন ৬১, তখন ছিল সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচি। এখন পুরোদস্তুর নয়া উদার কর্মসূচি। যথারীতি অ্যাজেন্ডায় খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদের বেপরোয়া লুট। আলোচনায় রামমন্দির, ৩৭০, সিএএ। সংসদে বামপন্থিদের সংখ্যা কমেছে ঠিকই। কিন্তু বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের অ্যাজেন্ডা তৈরিতে সামনের সারিতে রয়েছেন বামপন্থিরাই। ঠিক করে দিচ্ছেন লড়াইয়ের অভিমুখ। তা সে ৩৭০ ধারা খারিজই হোক, আর সিএএ, কর্পোরেটমুখী কৃষি আইন, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তিই হোক, কিংবা নির্বাচনী বন্ড- প্রতিটি ক্ষেত্রে বামপন্থিরা প্রতিবাদের সামনের সারিতে। নিজেরা রাস্তায় নেমেছেন, নামিয়েছেন দেশকে। বামপন্থিদের কথা, সাম্য-সমতা, জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনজাতি জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা, স্বকীয়তা বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে তাকে মর্যাদা দেওয়ায়। কখনো তাকে অস্বীকার করা নয়। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যসাধন। বিপরীতে উগ্র দক্ষিণপন্থিরা চায় বিভাজন। অস্বীকার করে এই বৈচিত্র্যকে। তথাকথিত ঐক্যের নামে জোর দেয় অভিন্নতায়। অস্বীকার করে ঐতিহাসিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ম ভাষা বর্ণ সংস্কৃতি আচার রীতিনীতির বৈচিত্র্যকে। এখানেই বামপন্থার সঙ্গে সঙ্ঘের মতাদর্শের সংঘাত। যেমন পাঁচ বছর আগে ত্রিপুরায় বামপন্থিদের হারিয়ে মোদী বলেছিলেন- বিজেপি’র এই জয় নিছক একটি নির্বাচনী জয় নয়, আসলে ‘মতাদর্শের জয়’! ফল ঘোষণার তিনদিন বাদে বিজেপি’র সংসদীয় দলের বৈঠকে মোদী বলেছিলেন, ‘গত ২৫ বছর ধরে ত্রিপুরা ছিল মার্কসবাদীদের দুর্গ! সে কারণে এটি একটি মতাদর্শগত জয়।’ যোগ করেছিলেন, ‘গোটা বিশ্বে এটি (মার্কসবাদ) শেষ হয়ে গিয়েছে, আমাদের দেশেও শেষের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, একমাত্র কেরালায় ক্ষমতায় রয়েছে।’ তার ঠিক একদিন আগে রাম মাধব যেমন শুনিয়েছিলেন, ‘একজন বিদেশি কূটনীতিক’ এককথায় ‘ত্রিপুরার জয়ের তাৎপর্য যথার্থ ব্যাখ্যা করে’ তাঁকে টেক্সট করেছেন: ‘অভিনন্দন রাম! বিশ্বে কমিউনিস্টদের প্রয়োজন নেই।’ এখানেই বামপন্থার গুরুত্ব। ১৩৪ কোটির দেশে মাত্র ৪০ লক্ষ মানুষের বাস, সাকুল্যে ২টি লোকসভা আসন, মেরেকেটে ৬০টি বিধানসভা আসন- এহেন একরত্তি রাজ্যে জয়কে এভাবেই দেখে আরএসএস-বিজেপি। বামপন্থিদের অবস্থান স্পষ্ট: আরএসএস-বিজেপি’র রাজনৈতিক মতাদর্শই দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ। বিপরীতে আরএসএস-বিজেপি বিলক্ষণ জানে, বামপন্থিদের মতাদর্শই তার মোকাবিলায় সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। সংসদে ক’টা আসন রয়েছে, তা দিয়ে বামপন্থিদের শক্তি এখন বিচার্য হচ্ছে না। বরং এই মুহূর্তে ভারতকে বাঁচানোর বিকল্প যে বামপন্থিদের আদর্শেই রয়েছে, এটা বুঝতে পারছে বলেই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দলগুলি বিরোধীদের মঞ্চে বামপন্থিদের গুরুত্ব দিচ্ছে। সঙ্ঘের প্রধান ভাগবতও এই কারণেই বামপন্থিদের মূল শত্রু হিসেবে আক্রমণ করেছেন। অনেকেই বিজেপি’র বিরোধী। কিন্তু বামপন্থিরা শুধু বিরোধিতাই করছেন না। আরএসএস-বিজেপি’র রাজনৈতিক মতাদর্শের বিকল্প তুলে ধরছেন। আর এখানেই বামপন্থিদের গুরুত্ব। সৌজন্যে : মার্কসবাদী পথ

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..