আর শিহরিত হতে চাই না

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত এক যুগে তিন হাজারের উপর মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে চলতি বছর প্রথম সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। এর মধ্যে জুলাই মাসেই সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৫০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে; যার মধ্যে ৪৭টি ছিল ‘বন্দুকযুদ্ধের‘ ঘটনা। আগস্ট মাসে মাত্র একটি ঘটনা ঘটেছে। এর আগে, ২০১৮ সালে ৪৬৬ জন, ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন একজনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশে কমবেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য মানুষ বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট‘কে অনেক বেশি মনে রাখবে। কারণ তখন থেকেই এটা বেগবান হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার হিসাব মতে, ২০০২-০৬ সালে মোট এক হাজার ১৫৫ জন ব্যক্তি বিনাবিচার হত্যার শিকার হন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যে বিএনপি ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ শুরু করেছিল, সেই বিএনপিই এখন নির্বাচনী অঙ্গীকারে, সংসদে, সংবাদ সম্মেলনে, সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হরহামেশাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি তুলছে। সম্প্রতি বিএনপির দুজন সংসদ সদস্য সংসদে এ নিয়ে কথা বলেছেন, তাঁরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেছেন। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দিয়েছেন, এমনটা গণমাধ্যমে আসেনি। কিন্তু সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে এক ফোঁড় খোঁচা দিয়ে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান এই দেশে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করে পরে খালেদা জিয়া সেটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। এটা খুব সত্য। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে বিচারের নামে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা, সদস্যকে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের এই দায় থেকে বিএনপি নিজেকে কোনোভাবেই মুক্ত করতে পারবে না। তাহলে এখন যারা বা যে সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে তারা সেই দায় থেকে মুক্ত হন কীভাবে? আর সরকারি দলের কথা অনুযায়ী, জিয়াউর রহমানের অনুসারীরাই তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এখনো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে? দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে যেকোনো সচেতন, মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে আসছে। তারপরেও এই হত্যাকাণ্ড চলছে এবং দিনে দিনে তা বাড়ছেই। সব সরকারের আমলেই তা হচ্ছে। কেন চলছে সেই উত্তর এখনো অজানা। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ নিহতের ঘটনার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আবারও সামনে আসে। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের একটি তল্লাশি চৌকিতে ঈদের আগের রাতে পুলিশের এক পরিদর্শক তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় সিনহার বোন বাদী হয়ে যে মামলাটি করেছেন তার অধিকাংশই পুলিশের সদস্য এবং তাদের সংশ্লিষ্ট। সৌন্দর্য্যের এই বেলাভূমিই ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যার লীলাক্ষেত্র। প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমগুলো দিনের প্রথম প্রতিবেদন শুরু করতো এখানকার কথিত বন্দুকযুদ্ধের খবর পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। সিনহা নিহতের ঘটনার পর সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে গেছে। সারা বছরই যদি এরকম থাকে তাহলে ক্ষতি কী- এমন অভিমত অনেক মানুষেরই। পাশাপাশি এই প্রশ্নটিও উঠেছে তাহলে কার স্বার্থে এই বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম আর খুন সংঘটিত হচ্ছে? সিনহা হত্যার তদন্ত প্রতিবেদনের কিছু অংশ গণমাধ্যমে এসেছে। সেখানে যেসব তথ্য ও দৃশ্যের দাবি করা হয়েছে তা রীতিমতো শিউরে উঠার মতো। সমাজে অপরাধ আছে, তা দমন করার জন্য আইনশৃঙ্খরা বাহিনী রয়েছে, বিচারবিভাগ রয়েছে। কিন্তু অপরাধ দমনের নামে যদি গোটা ব্যবস্থাটাকেই অপরাধপ্রবণতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয় তাহলে বিচারবিভাগ মুখ থুবড়ে পড়বে এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। আর যাই হোক, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আইনের শাসনের অংশ হতে পারে না। সমাজকে, রাষ্ট্রকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই অপরাধপ্রবণতার ঝোঁক থেকে বের করে আনাই আইনের শাসনের প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব। মানুষকে শিহরিত করার দায় রাষ্ট্রের নয়। কোনো নাগরিক কোনো সভ্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে শিহরিত হওয়ার মতো আচরণ আশা করে না।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..