‘বনলতা সেন’ ইতিহাসের বিরল চরিত্র

Posted: 14 জানুয়ারী, 2018

লাবণী মণ্ডল : উনিশ শতকের পূর্বেও যুগ যুগ ধরে নারীদের জন্য অবরোধপ্রথা (পর্দাপ্রথা) শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও প্রচলিত ছিল। উনিশ শতকে এসেও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে নারীরা ছিল পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। নারীদের শিক্ষার বিস্তার ও সুযোগ বিস্তৃত না হওয়ার কারণেও নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে জীবন নির্বাহ করতেন। আর্থিক ক্ষমতা না থাকার কারণে নারীরা ছিলেন আরও পরনির্ভরশীল–বিবাহিত জীবনে স্বামীর ওপর এবং অন্যান্য জীবনে অভিভাবকদের ওপর। অন্যদিকে ধর্মীয় সংস্কার ও বাধ্যবাধকতার জন্যও নারীরা অবরোধের মধ্যে বাস করতেন। তবুও নারীরা এগিয়েছিলেন। শত বাধাকে অতিক্রম করেই ব্রিটিশকে তাড়িয়েছিলেন। তাঁদের লড়াইটা ছিল আরো কঠিন। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাঁদের পথটা এতো সহজ ছিল না–আজও সহজ নয়। তবুও নারীদের এই সংগ্রামী অবদানের কারণেই আজ আমরা মাঠে/ময়দানে শ্লোগান তুলতে পারি। প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করার পেছনে অতীতে গৌরবোজ্জ্বল নারীদের অবদানই যথেষ্ট। সেই পুরনো সময়ের অবস্থাটা এখনও আছে, প্রবলভাবে আছে, শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আছে। এখনও মৌলবাদীগোষ্ঠী নারীর অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য বিভিন্নভাবে অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়– প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নারীর অবদান। তবু যুগ যুগ ধরে নারীর এই অবদান ইতিহাসে কতটুকুই আর লিপিবদ্ধ রয়েছে? প্রথমত: নারীর ইতিহাস লিখার জন্য নারীদের মধ্য থেকে যে চেতনাশক্তির দরকার তা দাঁড়ায় নি। দ্বিতীয়ত: পুরুষতান্ত্রিক, ভোগবাদী সমাজে নারীকে ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করা হয়। বাকিটা খারিজ করে দেয়ার চেষ্টা চালায় পুরুষ। তবুও কিছু মহান মানুষ জন্মেছিলেন– যাঁরা নারী-পুরুষের ভেদাভেদ না রেখে যতটুকু সম্ভব ইতিহাস রেখে গেছেন। যে কারণেই আমরা তরুণ প্রজন্ম কিছুটা হলেও জানতে পারি। অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই ঢাকার অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, চট্টগ্রামের দি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, মালামার বিপ্লবী দল, কলকাতার অনুশীলন সমিতি, মেদিনীপুর বিপ্লবী দল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন, স্বরাজ পার্টিসহ অন্যান্য বিপ্লবী দল স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এসব দলের অসংখ্য বিপ্লবী সদস্যরা ভারতমাতার স্বাধীনতার জন্য আজীবন লড়াই করেন। সেই লড়াইয়ে বনলতা সেনও শামিল হয়েছিলেন। বনলতা সেন/চক্রবর্তী, সুশীলা মিত্র, যশোদা রাণী সরকার, পারুল মুখার্জি, চারুশীলা দেবী, ম্যাডাম কামা, রেণু সেন/বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, আয়েশা বানু, আরতি রক্ষিত (সিংহ), ঊর্মিলা দেবী, লাবণ্যপ্রভা দাশগুপ্তা, ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা, ইলা সেন, ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাস, লাবণ্যপ্রভা দত্ত, কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা, শোভারাণী দত্ত, সরমা গুপ্তা, সরযূবালা সেন/গুপ্তা, সরোজিনী নাইডু, মৃণালিনী সেন, প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায়, কনক মুখোপাধ্যায়, বনলতা দাশগুপ্তা নীনা, রাসমণি, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, মনোরমা বসু মাসিমা, হেনা দাস, কল্পনা দত্ত, সুনীতি চৌধুরী, নেলী সেনগুপ্তা, সাবিত্রী দেবী, সুহাসিনী গাঙ্গুলি, সরলাদি, জয়মণি বর্মণ, বাসনা, বীণা দাস, মাতঙ্গিনী হাজরা, মণিকুন্তলা সেন ও অনিলা দেবীসহ শত শত নারীদের অবদানে আজ আমরা স্বাধীন জন্মভূমি পেয়েছি। আমাদের এই দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার পেছনে এঁদের ভূমিকা অতুলনীয়। কতটুকুই বা রয়েছে ইতিহাসের ‘খেরোখাতা’য়? বর্তমান পুঁজিবাদী, ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় নারীসমাজকে এঁদের ইতিহাস জানতে হবে, পাঠ করতে হবে। নারী আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে, দৃঢ় করতে হলে এঁদের ইতিহাস জানাই প্রথম ধাপ হওয়া উচিত। এই শোষক রাষ্ট্রযন্ত্র নারীকে ‘পণ্য’ বানিয়ে নারী স্বাধীনতার নামে মুলো ঝুলিয়ে রেখেছে। এটা অত্যাধুনিক নারীসমাজকে উপলব্ধি করতে হবে এবং এখনই তার সময়। নচেৎ ইতিহাসের লড়াকু নারীদের জীবনদান ব্যর্থ বলেই প্রমাণিত হবে। বনলতা সেনের নাম হয়তো আজ এই ছোট্ট লেখনির মাঝে অনেকেই প্রথম জানতে পারবে। আমি নিজেও যে খুব বেশি দিন আগে জানতে পেরেছি তা নয়। এই তো ২০১৪ সালেই পরিচিত হই। এই ব্রিটিশবিরোধী তেজস্বী নারীদের সাথে। যাঁদের আত্মত্যাগ সুবিধাবাদী, ভোগবাদী চেতনার কারফিউ ভেঙে দেওয়ার জন্য আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে, আলোড়িত-আন্দোলিত-উজ্জীবিত করে। কিন্তু চিন্তার জোরটা যদি ঝামেলামুক্ত না হয় তবে এই ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে নারীদের মুক্তি মিলবে না। যত ইতিহাসই লেখা হোক না, যত পাণ্ডিত্যই দেখানো হোক না- এই চিন্তার কারফিউ ভেঙে নারীসমাজকে মুক্তির সাথে সাথে পুরো মানবসভ্যতাকে মুক্ত করার দায় নিতে হবে। বনলতা সেন। ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তার নাম। হয়তো এ কথাটি তিনি জানতেনও না বা জানার কথাও না। কিছুটা গৌরব অনুভব করি এ কারণে যে, এই বনলতা সেনের জন্ম বাংলাদেশেই। ফরিদপুর জেলার কার্তিকপুরে। ১৯১৫ সালে জন্মেছিলেন। তাঁর সময়ের অনেক বিপ্লবীর আত্মত্যাগ ইতিহাসে লেখাও রয়েছে। বাবা কালীপ্রসন্ন সেন ছিলেন স্বদেশি। এটাই ছিল বনলতা সেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাবার স্বদেশি হওয়ার সুবাদে তিনি আজীবন লড়াইয়ে শামিল থেকে যেতে পেরেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের স্বদেশিভাবাপন্ন মনোভাব তাঁকে আকৃষ্ট করে। পরিবারের কাছেই হাতেখড়ি। স্কুলে পড়াশোনার সময়েই বনলতা সেন স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৩০ সাল। বনলতার বয়স তখন ১৫ বছর। তারুণ্যতার অদম্য স্পৃহা। এই তো মোক্ষম সময়। হ্যাঁ, ১৫ বছর শৈশব পেরিয়ে, কৈশোরে পদার্পণের বয়স। যে বয়সে হেসে, খেলে বেড়ানোর কথা। কিন্তু না, তা নয়! এই সময়ে পুরোপুরিভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন– বনলতা সেন। এই বয়সেই বিপ্লবী অনুশীলন দলের সাথে কাজ করা শুরু করেন। বিপ্লবী অনুশীলন দলের সদস্য হওয়ার পর থেকেই আরো দৃঢ়ভাবে, সংগঠিতভাবে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্রত গ্রহণ করেন। গ্রামে, গ্রামে ক্লাব ও লাইব্রেরি স্থাপনে প্রধান ভূমিকাও রাখেন তিনি। এই ক্লাবগুলোতে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। বিপ্লবী বই পড়িয়ে অনুপ্রেরণা জোগানো হতো। তরুণদের মধ্যে স্কুলিং করে– ব্রিটিশদের বর্বর চরিত্রের কথা তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল এই লড়াকুদের। ক্লাবটিতে ছোরা চালনা ও লাঠি খেলার প্রশিক্ষণও দিতেন বিপ্লবী বনলতা সেন। এই ক্লাব পরিচালনার পাশাপাশি বনলতা সেন মহিলাদের সংগঠিত করার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন। এটাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। ‘মহিলা কর্মী সংঘ’, ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে তিনি মহিলাদের সংগঠিত করেন। প্রথমে তাদেরকে ব্রিটিশদের ন্যাক্কারজনক ঘটনাবলীর বর্ণনা দেন। ব্রিটিশদের হাত থেকে এই দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করতে হবে বলে প্রলুব্ধ করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন সম্পর্কেও সচেতন করে গড়ে তোলার কাজ করতেন– বনলতা সেন। ১৯৩০-৩৪ সাল এই চার বৎসর বিপ্লববাদী আন্দোলন অত্যন্ত প্রসার লাভ করে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০ সাল) হতে শুরু করে দার্জিলিং এ লাটসাহেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া (১৯৩৪ সাল) পর্যন্ত কাজগুলির ভিতর দিয়ে বাংলার যুবক বিপ্লবীরা যে অসাধারণ সাহস ও সাংগঠনিক কৃতিত্বের পরিচয় দেন, পদ্ধতির দিক দিয়ে ভুল হলেও তা যে কোনো দেশের পক্ষে গৌরবের বিষয় হতে পারে। এর ফলে কয়েক হাজার যুবক দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ হন, আরও কয়েক হাজার যুবক বৎসরের পর বৎসর স্বগৃহে অন্তরীণ থাকতে বাধ্য হন এবং বহুসংখ্যক ফাঁসিকাষ্ঠে কিংবা বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে জীবন দেন। এই কয় বৎসরেরই আবার কংগ্রেসের নেতৃত্বে সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণআন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়, যার ফলে দুই লক্ষের মত লোক কারারুদ্ধ হন, বহুসংখ্যক লোক বিভিন্নভাবে জীবন দেন এবং অগণিত জনসাধারণ চরম নির্যাতন ভোগ করেন। এই কয় বৎসর ছিল সারা ভারতে এক বিপ্লবী অভ্যুত্থানের যুগ। ১৯৩৭ সাল। ২২ বছরের তেজোদীপ্ত তরুণী বনলতা সেন। এসময় তাঁর চিন্তার স্তর আরো অনেক উঁচুপর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাই ভাবি! আমাদের এই বাইশ অতিক্রম করা তরুণীরা কে কোথায় অবস্থান করছেন? এই সমাজসভ্যতাকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রয়েছে? বনলতা সেন তখন বন্দিমুক্তি আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্র আন্দোলনে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে ‘অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস কমিটি’র সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। বিপ্লববাদী দলে যুক্ত থাকার পাশাপাশি ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র পরিচালিত কংগ্রেসের রাজনীতিতেও যোগদান করেন বনলতা। ১৯৪২ সাল। এই সালটির ইতিহাস আমাদের অনেকেরই কমবেশি জানা রয়েছে। ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে একটি বেআইনন শোভাযাত্রার পুরোভাগে থাকার ফলে তিনি পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হন এবং গ্রেফতার হন। বিনা বিচারে তাঁকে কারাবন্দি রাখা হয় প্রায় তিন বছর। প্রেসিডেন্সি জেলে নিরাপত্তা বন্দি ছিলেন বনলতা সেন। কিন্তু বিপ্লবী তেজ যাঁর ভেতরে থাকে তাঁকে অবদমন করার ক্ষমতা কার রয়েছে? এই জেলে বন্দি থাকাবস্থায়ই তিনি এম.এ. পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন। ১৯৪৫ সালে মুক্তিলাভের পর তিনি আবারও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে অনুশীলন দলের বিপ্লবী সরোজ কুমার চক্রবর্তীকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। ১৯৪৬ তিনি কলকাতায় দাঙ্গা বিধ্বস্তদের মধ্যে কাজ করেন তিনি। ত্রাণকার্য পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সেই সময় নানা স্থানে শ্রমিক আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি পুরোপুরি বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যান। সমাজতন্ত্রই যাঁর একমাত্র ব্রত। একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই যাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। এই পৃথিবীটাকে সাম্য, ভালোবাসার পৃথিবী হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন– ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী বনলতা সেন। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত ছিলেন। ৭৩ বছর বয়সে ১৯৮৮ সালের ৩১ জানুয়ারি এই বিপ্লবী মারা যান। জয়তু বিপ্লবী বনলতা সেন। লেখক : অনলাইন, এক্টিভিস্ট তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের নারী চরিতাভিধান, বিপ্লবী চরিতাভিধান, শত নারী বিপ্লবী, নারী মুক্তি প্রশ্নে