ইলা মিত্রের জবানবন্দি
Posted: 19 অক্টোবর, 2025
১৯৫০ সালে তেভাগা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে নাচোলে বিদ্রোহীদের ওপর পুলিশি দমন-পীড়নের পর রাজশাহী কোর্টে মামলা চলাকালে ইলা মিত্র তাঁর ওপর পুলিশের জঘন্য ও নৃশংস অত্যাচারের বর্ণনা করে এই ঐতিহাসিক জবানবন্দি দেন--
কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিগত ৭-১-৫০ তারিখে আমি রহনপুরে গ্রেপ্তার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোলে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধর করে এবং তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার না করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে- এই বলে এসআই আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার মতো কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার সব কাপড়চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখে। আমাকে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি, এক বিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় এসআইয়ের উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর আমার কাপড়চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত প্রায় ১২টার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবত এসআইয়ের কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না।
যে কামরায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা নানা রকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাল। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিল এবং সে সময় চারধারে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা বলেছিল যে আমাকে ‘পাকিস্তানি ইনজেকশন’ দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময় তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিয়েছিল। জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলেছিল। সেপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, ‘কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব ছিল না।’
সেলের মধ্যে আবার এসআই সেপাইদের চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বলল, ‘এবার সে কথা বলবে’। তারপর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিত করে শুইয়ে রাখল এবং একজন আমার যৌনাঙ্গের মধ্যে একটা গরম সেদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
৯-১-৫০ তারিখ সকালে যখন আমার জ্ঞান ফিরল, তখন উপরিউক্ত এসআই ও সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করল। এরপর আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হলো। সে সময় আধা অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এসআইকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, আমরা আবার রাতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো, তাহলে সেপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাতে এসআই ও সেপাইরা ফিরে এল এবং তারা আবার সেই হুমকি দিল। কিন্তু যেহেতু তখনো কিছু বলতে রাজি হলাম না, তখন তিন-চারজন আমাকে ধরে রাখল এবং একজন সেপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করল। এর অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।
পরদিন ১০-১-৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন আমি দেখলাম যে আমার দেহ থেকে প্রচণ্ডভাবে রক্ত ঝরছে, আর আমার কাপড়চোপড় রক্তে সম্পূর্ণভাবে ভিজে গেছে। সেই অবস্থায়ই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলো। নবাবগঞ্জ জেল গেটের সেপাইরা জোরে ঘুষি মেরে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল।
সে সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সেপাই একটি সেলের মধ্যে আমাকে বহন করে নিয়ে গেল। তখনো রক্তপাত হচ্ছিল এবং খুব বেশি জ্বর ছিল। সম্ভবত নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার সে সময় আমার জ্বর দেখেছিলেন ১০৫ ডিগ্রি। যখন তিনি আমার কাছে আমার প্রচণ্ড রক্তপাতের কথা শুনলেন, তখন তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং কয়েক টুকরা কম্বলও দেওয়া হলো।
১১-১-৫০ তারিখে সরকারি হাসপাতালের নার্স আমাকে পরীক্ষা করলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কী রিপোর্ট দিয়েছিলেন, সেটা জানি না। তিনি আসার পর আমার পরনে যে রক্তমাখা কাপড় ছিল, সেটা পরিবর্তন করে একটা পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হলো। এই পুরো সময়টা আমি নবাবগঞ্জ জেলের একটি সেলে একজন চিকিৎসকের অধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব বেশি জ্বর ছিল, তখন আমার প্রচণ্ড রক্তপাত হচ্ছিল এবং মাঝেমধ্যে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।
১৬-১-৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা হলো এবং আমাকে বলা হলো যে পরীক্ষার জন্য আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। খুব বেশি শরীর খারাপ থাকার জন্য আমার নড়াচড়া সম্ভব নয়, এ কথা বলায় লাঠি দিয়ে আমাকে একটা বাড়ি মারা হলো এবং স্ট্রেচারে উঠতে আমি বাধ্য হলাম। এরপর আমাকে অন্য একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি সেখানে কিছুই বলিনি, কিন্তু সেপাইরা জোর করে একটা সাদা কাগজে সই আদায় করল। তখন আমি আধা অচেতন অবস্থায় খুব বেশি জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল, সেজন্য আমাকে নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হলো। এরপর আমার শরীরের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলো, তখন আমাকে ২১-১-৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানে জেল হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো।
কোনো অবস্থায়ই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি এবং ওপরে যা বলেছি, তার বেশি আমার আর বলার কিছু নেই।