নাচোল ও ইলা মিত্র
Posted: 19 অক্টোবর, 2025
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক। ইলা মিত্র কলকাতায় যাওয়ার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেলে হক সাহেব তাকে বলেন, ‘তুই চিকিৎসা শেষ করে আর এদেশে ফিরিস না। মুসলিম লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে এলে তোকে ওরা মেরে ফেলবে।’
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রেক্ষাপটটি এই রকম- স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগের শাসন। তখন ওই প্রদেশে লীগের বিরোধী শক্তি ছিল কেবল কমিউনিস্ট পার্টি। সদ্য ভূমিষ্ঠ আওয়ামী লীগ সবে শক্তি বাড়াতে শুরু করেছে। আবার সেই সময় সমগ্র প্রদেশের মানুষ ছিল সাধারণভাবে পাকিস্তান প্রাপ্তির আনন্দে বিভোর এবং একই সঙ্গে চরম হিন্দু-বিদ্বেষী। যেহেতু কমিউনিস্টদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু তাই তাদের কাছে হিন্দু আর কমিউনিস্ট হয়ে উঠেছিল সমার্থক। জনগণের এই বিরূপতার সুযোগ নিয়ে লীগ সরকারের পুলিশ কমিউনিস্টদের ওপর প্রবল নির্যাতন নামিয়ে আনে। ‘৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে সাতজন কমিউনিস্টকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর ঘটে নাচোলের ঘটনা। বলাবাহুল্য, এইসব খবর তখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো না, হলেও তাতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতো খুব কম।
ইলা মিত্রের আদিবাড়ি ছিল যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার বাগুটিয়া গ্রামে। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকতেন এবং সেখানেই ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর তার জ্যেষ্ঠা কন্যা ইলা সেনের জন্ম। ’৪৪ সালে ইলা কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক হন। ‘৪৫ সালে দোল পূর্ণিমার রাতে তার বিয়ে হয় রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে।
ইলা সেন ছেলেবেলায় ছিলেন দক্ষ অ্যাথলিট, সাঁতারেও তার জুড়ি ছিল না। তিনি যখন রাজনীতিতে যোগ দেন তখন তিনি বেথুন কলেজে পাঠরত। ‘৪৩ সালে তিনি হন মহিলা আত্মরক্ষা কমিটির সদস্য। কমিউনিস্টদের এই প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দিয়ে তিনি ভুখা মিছিল, লঙ্গরখানা ইত্যাদি পরিচালনার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
অন্যদিকে রমেন্দ্রনাথ ছাত্রাবস্থায় তার মায়ের সঙ্গে বালিগঞ্জে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। ’৩৫-’৩৬ সালে মস্কো ফেরত নেতা গোপেন চক্রবর্তী তাকে শ্রমিক আন্দোলনে নিয়ে আসেন। পরে তিনি বর্ধমানে গিয়ে কৃষক আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণের কাজ করতে গিয়ে তার সুশোভন সরকার, মণিকুন্তলা সেন, নিখিল চক্রবর্তী প্রমুখ বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়।
রামচন্দ্রপুর অনেকে রমেন্দ্রনাথকে জমিদার সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা তিনি ছিলেন না। আসলে রমেন্দ্রনাথের বাবা মহিমচন্দ্র ছিলেন সন্নিহিত কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামের জমিদার শামসের উদ্দিন মিঞার অধীনস্ত জোতদার এবং মেদিনীপুর জমিদারি এস্টেটের নায়েব। তবে তার জমি-জমা কিছু কম ছিল না।
রমেন্দ্রনাথের বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবার মৃত্যু হয়। কার্যত তখন থেকেই সংসারের হাল ধরেন তার মা বিশ্বমায়া। এই তেজস্বী মহিলা দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে রাজি হননি বরং ’৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রামচন্দ্রপুরে এক বর্ণাঢ্য সভা করে স্বাধীনতা দিবস পালন করেছিলেন। সেই সভায় পাকিস্তানের পতাকা তোলেন রমেন্দ্রনাথ। বিশ্বমায়াকে দেখে সাহস পেয়ে আরও কিছু হিন্দু পরিবার সেদিন রামচন্দ্রপুরে থেকে গিয়েছিলেন।
এদিকে কলকাতায় যখন দুর্ভিক্ষে ত্রাণের কাজ চলছে, তখন রমেন্দ্রনাথ ছিলেন পার্টির বালিগঞ্জ সেলের সম্পাদক। পরে পার্টি থেকে তাকে কৃষক সংগঠন করার জন্যে মালদা জেলার সম্পাদক করে পাঠানো হয়। এতদিন শহুরে রাজনীতি করা রমেন্দ্রনাথের কাছে এটা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিলাভ বাংলার গ্রাম-গঞ্জে একটা নতুন চেতনার হাওয়া তৈরি করেছিল। কারণ, কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামের জমিদার রমেন্দ্রনাথের বন্ধু আলতাফ মিঞা স্বাধীনতার পর নারী শিক্ষার জন্যে একটা স্কুল খোলার উদ্যোগ নিলেন। দেখা গেল, হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের ধনী মানুষেরই তাতে প্রবল আপত্তি। তারা বলতে লাগলেন, নারী শিক্ষা শরিয়ত বিরোধী। বিষয়টি নিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে কয়েকটি বিতর্ক সভা হলো। আশ্চর্যজনকভাবে তখন এগিয়ে এলেন গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা।
নারী শিক্ষার পক্ষে দাঁড়িয়ে এক নিরক্ষর খেতমজুর ওয়াজেদ আলি মোড়ল বলেছিলেন, মেয়েরা লেখাপড়ার জন্যে স্কুলে এলেই বুঝি শরিয়ত বিরোধী কাজ হয়। আর জোতদারের বাড়িতে বেগার খাটতে গেলে হয় না! ধনীরা যে যথেচ্ছ মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করে তার কি শরিয়তে সম্মতি আছে। ধনীদের পরিবারের স্ত্রী-পুত্রের জন্যে গরিব মেয়েরা যে দূর-দূরান্ত থেকে জল বয়ে নিয়ে আসে তার নির্দেশ শরিয়তের কোথায় লেখা আছে।
শেষ পর্যন্ত গ্রামের গরিব কৃষকদের তীব্র আগ্রহের কাছে হার মানলো ধনী জোতদাররা। স্কুল চালু হলো এবং ইলা মিত্র হলেন তার প্রধান শিক্ষিকা। বলাবাহুল্য, স্কুল প্রতিষ্ঠা নিয়ে এই ধনী দরিদ্রের লড়াই ইলা মিত্র ঘরে বসে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং এটা ছিল তার কৃষক রাজনীতিতে প্রবেশের প্রথম ধাপ।
নাচোল র্যাডক্লিফ সীমান্ত কমিশনের রায় অনুযায়ী মালদা জেলার পাঁচটি থানা নবাবগঞ্জ, ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, নাচোল ও গোমস্তাপুর রাজশাহী জেলায় যুক্ত হয়। এর মধ্যে নবাবগঞ্জ ও নাচোল থানা দুটি পাশাপাশি। মধ্যবর্তী পথটি বড়জোর ৮/১০ মাইলের। প্রসঙ্গত, সেই বিশ শতকের গোড়া থেকেই মালদা, দিনাজপুর বা জলপাইগুড়ির মত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি ছিল আদিবাসী অধ্যুষিত। মালদার গ্রামগুলিতে হিন্দু ও মুসলিম কৃষক থাকলেও সংখ্যাগুরু ছিল সাঁওতালরা। অতীতে তারাই এইসব এলাকায় ঝোপ, ঝাড়, জঙ্গল সাফ করে চাষাবাদ চালু করেছিল। সিপাই বিদ্রোহেরও আগে ১৮৫৫ সালে যে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ হয় তার ঢেউয়ে প্লাবিত হয়েছিল মালদা জেলাও। ওই জেলার আদিনা মসজিদের কাছে জিতু সর্দার নামে এক বিদ্রোহী নেতা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যাশামতই আদিবাসীদের লাঠি, বল্লম, তির-ধনুকের মতো হাতিয়ার ব্রিটিশদের বন্দুক, কামানের সামনে পরাজিত হয়।
সেই বিদ্রোহের নেতা জিতু সর্দারের জনৈক সহকারী রামু সরকার পরে নবাবগঞ্জের কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হন। ফণিভূষণ মাস্টার নামে কৃষ্ণগোবিন্দপুর স্কুলের আর এক বৃদ্ধ শিক্ষকও যোগ দেন এই আন্দোলনে। তারা ১৯৩৭-৩৮ সাল থেকেই নবাবগঞ্জ, নাচোল ইত্যাদি এলাকায় কৃষক আন্দোলন করে আসছিলেন। এই আন্দোলনের সঙ্গেই যুক্ত হন মিত্র দম্পতি।
প্রসঙ্গত, নাচোল বিদ্রোহের বহু ইতিহাসবিদ এবং প্রত্যক্ষদর্শী তাদের বিবরণে ইলা মিত্রের বিশেষ সাংগঠনিক দক্ষতার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। কলকাতার বেথুন কলেজে পড়া এই মহিলা গ্রামের মেঠো রাস্তায় মিছিল করতেন, কৃষকের ঘরে ঘরে গিয়ে পুরুষ ও নারীদের সঙ্গে কথা বলতেন, কোলে টেনে নিতেন শিশুদের- সবকিছুই অত্যন্ত সাবলীলভাবে। তার কোনও দ্বিধা বা আড়ষ্টতা ছিল না। প্রয়োজনে তিনি অনেক কৃষকের ঘরে রাত্রিবাস করেছেন। দুপুর বা রাতের খাওয়া সেরেছেন একাসনে বসে।
ওয়াজেদ আলি মণ্ডলের ছেলে, হেফাজুদ্দিন মাস্টার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইলা মিত্র রামচন্দ্রপুরে আসার পর গোটা এলাকায় একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন হিন্দু আর আমরা মুসলিম। কিন্তু উনার সঙ্গে যখন মিশতাম তখন এই দুইয়ের মধ্যে যে একটা ব্যবধান তা উনি বুঝতে দিতেন না।
আবার নাচোলের আর এক কমরেড বৃন্দাবন সাহা চণ্ডীপুরে তাদের পার্টি অফিসের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এইরকম ‘আমরা যে ঘরে বসে আছি সেটি বাদে শুকচাদ কর্মকারের আর একটি মাত্র ঘর আছে। আমাদের পার্টি অফিসের একধারে কয়েকটি ছাগলও রাখা হয়। আমরা যখন পার্টির বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করতাম তখন এই মূক পশুগুলি একধারে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটতো। অন্যধারে দুটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিল হালের বলদের জন্যে।’
নাচোল এলাকায় ওই সময় মিত্র দম্পতি ছাড়াও আরও অনেক কৃষক নেতা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের আত্মত্যাগ বা সক্রিয়তাও কিছু কম ছিল না। কিন্তু স্থানীয় কৃষকরা ওদের মধ্যে কেবল ইলা মিত্রকেই ‘রাণী মা’ বলে সম্বোধন করতো। এই রাণীমা কোন রাজা-রাজড়ার কাহিনির চরিত্র নয়, এই ডাকে মিশে ছিল ইলা মিত্রের প্রতি তাদের বিশেষ সম্ভ্রম ও ভালোবাসা।
প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষক সমিতির ছিল একটিই প্রধান দাবি, তা হলো, সাত আড়ি ধান। এর মানে সাধারণভাবে বিশ আড়ি ধান কাটা বা মাড়াইয়ের পরে কৃষক পেত তিন ভাগ। সমিতি দাবি তোলে ওই তিন আড়িকে বর্ধিত করে সাত আড়ি করতে হবে। এই সময় ইলা মিত্রের নাম ও এই দাবিটিকে যুক্ত করে ওই এলাকায় একটি গান রচিত হয়েছিল লীলা মৈত্রী নারী / আইন করলো জারি / আধি জমি তেকুটি ভাগ / জিন হলো সাত আড়িরে ভাই / জিন হলো সাত আড়ি।
১৯৪৮ সালের ১ মে রাজশাহী জেলার পার্টি নেতা সীতাংশু মৈত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং রমেন্দ্রনাথের বাড়িতেও তারা হানা দেয়। এরপরই ইলা মিত্র নাচোলে সম্পূর্ণ আত্মগোপনে থেকে রাজনীতি শুরু করেন।
তেভাগার লড়াই ও প্রত্যাঘাত
যদিও স্বাধীনতা লাভের উচ্ছ্বাসে বাংলার সর্বত্রই তেভাগা আন্দোলন চাপা পড়ে গিয়েছিল তবু ‘৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে যেখানে সম্ভব সেইসব জায়গায় এই আন্দোলন আবার শুরু করতে হবে।
’৪৯ সালের মে মাস থেকে নাচোলের আশেপাশের গ্রামগুলিতে যাওয়া আসা শুরু করে পুলিশ। তারা নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর হামলা করতো আবার সামান্য ঘুষ বা সেলামি দিয়ে তাদের নিরস্তও করা যেত। কিন্তু কিছুদিন পরে তারা আবার ফিরে আসতো একই উদ্দেশ্যে। এর ফল হয়েছিল এই যে জোতদার, জমিদারদের মতো পুলিশও হয়ে ওঠে গ্রামবাসীদের কাছে শোষকতূল্য। তারা অন্যান্য শ্রেণি শত্রুদের সঙ্গে পুলিশকেও মিলিয়ে দেখতে শুরু করে।
উল্লেখ্য, নাচোল সন্নিহিত ঘাসুড়া গ্রামে ৫ জানুয়ারি কৃষকরা চার পুলিশকে হত্যা করে। এই ঘটনা নিয়ে সরকারি রিপোর্ট ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণীতে ভিন্নতা রয়েছে। তবে জানা যায়, ওই দিন সকালে চণ্ডীপুরে মাতলা মাঝির বাড়িতে সমিতির প্রধান ঘাঁটিতে উপস্থিত ছিলেন অনিমেষ লাহিড়ী, ইলা মিত্র, আজাহার হোসেন, বৃন্দাবন সাহা ও রমেন মিত্র। শেষের জন অবশ্য একটু পরেই এক জরুরি বৈঠকে যোগ দিতে ভারতে রওনা হয়ে যান। বৃন্দাবন সাহার বিবরণীতে আছে, ৫ জানুয়ারি সকালে গোরুর গাড়িতে চেপে নাচোল থানার দারোগা তিন সেপাই সহ ঘাসুড়া গ্রামে উপস্থিত হয়। কাছেই প্রফুল্লবাবু নামে এক জোতদারের খামারে হেলা মাঝি ও বদনা মাঝি নামে দুই আদিবাসী কৃষক ধান মাড়াই করছিল। পুলিশ ওই নিরীহ লোক দুটিকে ধরে নিয়ে এসে নানারকম ছল-ছুতোয় বেদম প্রহার শুরু করে। এক ফাঁকে হেলা মাঝি পালিয়ে যায় এবং চণ্ডীপুরে মাতলা মাঝির বাড়িতে এসে ওই ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানায়। এরপর এই নির্যাতনের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সতর্কবার্তা হিসাবে আশপাশের এলাকাজুড়ে বেজে ওঠে আদিবাসীদের নাকাড়া। সামান্য সময়ের মধ্যে প্রায় চার-পাঁচ হাজার কৃষক ও স্বেচ্ছাসেবী তির-ধনুক ও বল্লম হাতে ঘাসুড়া গ্রামে জড়ো হয়। তারা ওই রাইফেলধারী দারোগা ও সেপাইদের ঘিরে ফেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পুলিশদের মৃত্যু হয় কার্যত গণপ্রহারে। এককভাবে কারুকে দায়ী করা যায় না। ওই বিরাট সংখ্যক মানুষের সামনে তারা রাইফেল তোলার সুযোগও পায়নি। ক্ষুব্ধ জনতা তাদের চারজনকেই হত্যা করে দেহগুলি স্থানীয় শ্যামপুকুর গ্রামের এক নালায় ফেলে দেয়। থানায় এই ঘটনা গিয়ে জানায় গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান লালুনাথ কর্মকার। এই খবর নবাবগঞ্জ মহকুমা ও রাজশাহী জেলা সদরে পৌঁছালে প্রশাসন তখনই ওই এলাকায় সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেয়। সেনাবাহিনী পরের দিন ভোরেই চণ্ডীপুর আক্রমণ করে।
নাচোলের এক নেতৃস্থানীয় কমরেড বৃন্দাবন সাহা তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ৬ জানুয়ারি সূর্যোদয় আর সেনা হামলা প্রায় একই সঙ্গে আসে। ওদের প্রধান লক্ষ্য ছিল চণ্ডীপুর, যেখানে ছিল কৃষক সমিতির প্রধান ঘাঁটি। গুলির তাপে গ্রামে আগুন ধরে যায়। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে চণ্ডীপুর গ্রাম। কৃষক ফৌজ পিছু হটে পলানিয়াপাড়ায় যায়। সেখানেও আগুন জ্বলে ওঠে। বৃষ্টির মতো অঝোরে রাইফেলের গুলি আসতে থাকে চারিদিক থেকে। পলানিয়াপাড়ার পর আগুন লাগানো হয় জগদ্দলে, তারপর কেন্দুয়া। আদিবাসীদের মোট ১২টি গ্রাম আগুনে ভস্মীভূত হয়। গ্রামের সব ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, সেনার গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বহু আদিবাসীর, গ্রামগুলি সব জনশূন্য। ইলা মিত্র ও বৃন্দাবন সাহা রওনা হন পলাশকান্দর গ্রামের দিকে। সেখানে তখন জড়ো হয়েছেন পলাতক কমরেডরা। মাতলা মাঝি সহ অধিকাংশই ভারতে চলে যাচ্ছেন। অনিমেষ লাহিড়ী ও আজাহার হোসেন সেইদিনই রামচন্দ্রপুর থেকে গ্রেপ্তার হন। ৭ জানুয়ারি অন্য সকলের মতো ভারত যাত্রার জন্যে রওনা দিয়ে রহনপুর রেল স্টেশনে গ্রেপ্তার হন ইলা মিত্র ও বৃন্দাবন সাহা।
নির্যাতন
বৃন্দাবন সাহার বর্ণনায় আছে, রহনপুর থানায় ওদের ওপর কোনও মারধর হয়নি, বরং দুপুরে কচুরি ও তরকারি খেতে দেয়। ইলা মিত্রকে ওরা পাশের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন এক অফিসার। তিনি খাবার কথা জিজ্ঞাসা করায় ইলা মিত্র বলেন, রসুন ছাড়া সব চলে। তিনি বিএ পাশ শুনে অফিসারটি চমকে উঠলেন। ইলা মিত্র বললেন বিএ পাশ আবার বেশি হলো নাকি! এইসব মামুলি কথাবার্তা চললেও ওরা অপেক্ষা করছিলেন নাচোল থেকে ফৌজ আসার জন্যে। তারা এল গভীর রাত্রে। স্বয়ং দারোগা ফৌজ নিয়ে এসেছেন।
তারা নাচোল থানার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি পালটে গেল ৷ওই থানায় চারদিন ইলা মিত্র ও বৃন্দাবন সাহার ওপর যে নির্যাতন হয়েছিল তা চিরকাল মানব সভ্যতার ইতিহাসে চরম লজ্জা হিসাবে বিবেচিত হবে। পুলিশ ও সরকার তা গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল ঠিকই কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের যুব ও ছাত্রসমাজ, যারা ছিল পাকিস্তান আদায়ের আনন্দে উদ্বেল- তারাও সমর্থন করেনি এই নির্যাতন।
আশ্চর্য হলো, দুই দেশেই চরম ধিক্কার ও প্রতিবাদের কণ্ঠ শোনা গেলেও নাচোল থানার দারোগার কোনও শাস্তি হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও ঢাকা উচ্চ আদালতে জারি ছিল ওই মামলা।
সত্যেন সেন ইলা মিত্রের বয়ানে যে বিবৃতিটি দিয়েছেন তা এইরকম- ওরা প্রথম থেকে নির্দয়ভাবে মারতে শুরু করল। শুধু আমাকে নয়, আমাদের সবাইকে। মারপিটের ফলে আমি অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাম, আমার সর্বাঙ্গে বেদনা। ওরা আমাকে একটা ঘরের বারান্দায় বসিয়ে রাখলো। তারপর আমাদের সঙ্গে যে সকল সাঁওতাল কর্মীরা ছিল, আমার চোখের সামনে তাদের সবাইকে জড়ো করে বর্বরের মতো মারপিট করে চলল। .... রক্তে ওদের গা ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু কারু মুখে কোনও শব্দ নেই, কোনও যন্ত্রণার কাতরোক্তিও নয়। সত্যি বলতে কি, আমাদের এই বীর কমরেডদের জন্যে গর্বে আমার বুক ভরে উঠছিল। এত মার মেরেও তাদের মুখ খোলাতে পারছে না।
ইলা মিত্র বলেছেন, পুলিশের বক্তব্য একটাই। ওরা বলুক, ইলা মিত্র নিজেই ওদের পুলিশ হত্যার জন্য চাপ দিয়েছিল, তাহলেই সকলকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও পুলিশ ওদের কারু মুখ থেকে কোনও স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারলো না। ইলা মিত্রের চোখের সামনেই সেই অমানুষিক মার খেতে খেতে হরেক মণ্ডল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তার সারা দেহ। কিন্তু চোখের সামনে এমন মৃত্যু দেখেও কারু মুখে কোনও বিকার নেই।আজাহার হোসেন পরে বলেছেন, অন্তত ৫০-১০০ জন কৃষকের নাচোল থানায় পুলিশের অত্যাচারে মৃত্যু হয়েছিল। ওইদিন হরেন্সের সঙ্গে ঝড়ু কোচ ও বিজু মাঝি নামে আরও দুই আদিবাসীর মৃত্যু হয়েছিল, যদিও পুলিশ তা মানতে অস্বীকার করে।
ইলা মিত্র তার নিজের ওপর অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছেন রাজশাহী আদালতে তার জবানবন্দিতে। তিনি মুখ খুলতে রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু জেলবন্দি অন্য দুই কমরেড মনোরমা মাসীমা ও ভানু দেবীর পীড়াপীড়িতে তিনি রাজি হন। জবানবন্দিতে তিনি জানান, পুরো একবছর রাজশাহী কারাগারে বন্দি থাকেন। তার শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় তাকে মামলার জন্য আদালতে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি তখন ভুগছিলেন টাইফয়েড ও কালাজ্বরে। তার বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। এক পর্যায়ে তার অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়লে তাকে তড়িঘড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। ডাঃ কে এস আলমের নেতৃত্বে এক মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসার দায়িত্বভার নেন। তার খ্যাতি তখন এমন তুঙ্গে পৌঁছেছিল যে তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ছুটে আসতো। তার কঙ্কালসার চেহারা দেখে বোঝা যেত পুলিশি অত্যাচারের নির্মমতা। ’৫৪ সালে তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে মেডিকেল কলেজে দীর্ঘ আট মাস চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ