গণতন্ত্রহীনতা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতিয়ার
Posted: 21 সেপ্টেম্বর, 2025
ভারতীয় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ব্যর্থতার পটভূমিতে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়। ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের জন্ম হয়। শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক-শাসনতান্ত্রিক সংকটের সৃষ্টি হয়। যদিও ১৯৫৬ সালে সংবিধান রচিত হলেও তার ভিত্তিতে নির্বাচন করতে না পারা, দলাদলি ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন অব্যাহত থাকার পটভূমিতে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হয়। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ায়–গণতন্ত্রের সংকট অব্যাহত থাকে। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হলেও বাংলাদেশের বর্তমানে যে শাসনতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক সংকট চলছে তার উৎসমূল রয়েছে তার ঐ ঐতিহাসিক যোগসূত্রের মধ্যেই। এখনো পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র অধরাই রয়ে গেছে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে–এই বিতর্কের মধ্যে সৃষ্টি হয় ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন। সৃষ্টি হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার চেতনা। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ counter করে দেয় সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বকে। পূর্ব-পাকিস্তানে শুরু হয় ভাষা, স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের লড়াই। ১৯৫২ সালে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এবং ১৯৫৪ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্র ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সেন্টো-সিয়াটো বাতিলের দাবি তোলা হয়। হক-ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট–পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে ধস নামানো বিজয় অর্জন করে। বিজয়ের পর থেকেই যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। যার সাথে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত যুক্ত থাকে। এর ফলে যুক্তফ্রন্টে দলাদলির কারণে যুক্তফ্রন্টের ব্যর্থতা জনগণের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে।
সমগ্র পাকিস্তানে রাজনীতিতে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সরকার পতন ও গঠনে নানা ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। এই পটভূমিতে গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিন্তানে সামরিক আইন জারি করেন এবং সেনাবাহিনীর তৎকালীন সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে নিযুক্ত করেন। এদিকে আইয়ুব খান ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য ক’রে নিজে রাষ্ট্রপতির পদে বসেন। সমগ্র পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর গ্রেফতার, নির্যাতন ও হুলিয়া জারি করা হয়। প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে বেসিক ডেমোক্রেসি (বিডি) প্রথা চালু করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে পূর্ব-পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট হয়। আর ১৯৬৫ সালে বেসিক ডেমোক্রেসির সিস্টেমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের ছয়-দফা দাবি উত্থাপন এবং পূর্ব-পাকিস্তানে ছয়-দফা দাবিতে ৬ জুন ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আর্থসামাজিক কর্মসূচিসহ ১১-দফা দাবি উত্থাপিত হয়। আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানে আন্দোলন জঙ্গি রূপ ধারণ করে এবং ২৪ জানুয়ারি ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের অভূতপূর্ব গণঅভূত্থান সৃষ্টি হয়। আইয়ুবশাহী গ্রেফতার, নিপীড়ন নির্যাতনের পথ পরিত্যাগ করে এবং কৌশল পরিবর্তন ক’রে রাজবন্দিদের মুক্তি ও আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়, আর সংলাপের জন্য লাহোরে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। শেখ মুজিব ও কমরেড মনি সিংহসহ রাজবন্দিরা মুক্তি পান। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। গোলটেবিল বৈঠকের পর আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে আমন্ত্রণ জানান। আইয়ুবের করে যাওয়া সকল সাংবিধানিক পরিবর্তন বাতিলসহ ইয়াহিয়া দেশে নতুন করে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেন। ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেইম ওয়ার্ক (LFO) জারি ক’রে এক লোক এক ভোট অর্থাৎ জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচন মেনে নিয়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে–সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই বিজয়ের বিরুদ্ধে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের নানামুখী ষড়যন্ত্র। ফলস্বরূপ ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া স্থগিত ঘোষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। স্লোগান ওঠে– ‘সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা’। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের সাথে একদিকে বৈঠক-সংলাপ শুরু করে, অন্যদিকে গোপনে সামরিক প্রস্তুতি চালাতে থাকে। সংলাপ-বৈঠক ভেঙে দিয়ে ২৫ মার্চ পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট ও গণহত্যা শুরু করে।
২৬ মার্চ চট্টগ্রামের বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জনাব এমএ হান্নান। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন ‘On behalf of Bangabandhu Sheikh Mujibor Rahman’ – বলে। শুরু হয় বাঙালির বিভিন্ন বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ– জনযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। শুরু হয় কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ। অন্য পক্ষে চলে জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তির হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন-সহযোগিতা। চলে সরকার কর্তৃক শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন। আর জামায়াত কর্তৃক পাকিস্তানি সহযোগী বাহিনী হিসেবে আলবদর গঠন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে মেরুকরণ একদিকে পিন্ডি-পিকিং-ওয়াশিংটন অন্যদিকে ঢাকা-দিল্লি-মস্কো। পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, বিশেষ করে আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায় শান্তি, স্বাধীনতা ও প্রগতিশীল শক্তি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ১০ এপ্রিল ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে–‘সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যদা’ – স্বপ্ন ও অঙ্গীকার হিসেবে ঘোষিত হয়। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধান পায় বাংলাদেশ। ঐ বছর ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা গৃহীত হয়। সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত হয়-গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। ঘোষণা করা হয় ‘ধর্ম হবে যার যার, রাষ্ট্র হবে সবার’। দেশ প্রগতির পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ’৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে না। এটা গণতন্ত্রের যাত্রায় শুভকর ছিল না।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন না করে দলীয় সরকার গঠন, ছাত্রলীগে বিভক্তি, প্রথমে মুজিববাদের স্লোগান দিলেও পরবর্তী সময়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বক্তব্য দিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) জন্ম, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু শক্তির মধ্যে বিভক্তি– আর এই বিভক্তির সুযোগ নিতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তি।
শাসকদলের অভ্যন্তরে শুরু হয় দুর্নীতি ও পদ-পদবি নিয়ে দ্বন্দ্ব। বিশেষ করে শিল্প-কল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ ও জমির সিলিং নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। উগ্র বাম-ডানের ইন-অ্যাকশান-ধর্মী কর্মসূচির মধ্যে ভিন্নতা ও পার্থক্য থাকলেও কার্য-কারণে মিল হয়ে যাওয়া, মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরতা, যার ফলে জনবিচ্ছন্নতার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা– ১৯৭৪ সালেই পি.এল-৪৮০ গমের জাহাজ বঙ্গপোসাগর থেকে ফিরিয়ে নেয়া। ফলে সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষের। দুর্নীতি-আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মানুষের স্বপ্নভঙ্গ, হতাশা মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি ও অতীতাশ্রয়িতা বৃদ্ধি পায়। এই পটভূমিতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়। সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন করে। বাকশাল গঠিত হয়। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর একটি অংশ কুদেতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। রাজনীতির পটপরিবর্তন, আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। নৈরাজ্য, ক্ষমতার মধ্যে টানাপোড়েন, সামরিক বাহিনীতে ক্যু পাল্টা ক্যু ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ক্যু, জেনারেল জিয়াকে অন্তরীণ, জেলে চার নেতার হত্যাকাণ্ড, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশ থেকে পলায়ন, ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী জনতার বিপ্লব ও জিয়ার অন্তরীণ থেকে মুক্তি লাভ ঘটে। জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনীর প্রধান, পরবর্তীতে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি, ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ খন্দকার মুশতাকের বিদায়, ৬ নভেম্বর বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ, ’৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রশ্নবিদ্ধ হ্যাঁ-না ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জিয়ার রাষ্ট্রপতির আসন গ্রহণ, বিচারপতি সায়েমের বিদায় ঘটে। ’৭৮ সালে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সৃষ্টি হয় এবং ১৯৭৮ সালের ১৮ জুন কর্নেল ওসমানির সাথে সরাসরি ভোটে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। জিয়ার আমলে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন হয়। শাহ আজিজ, আব্দুল আলিমদেরকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী করা হয় এবং গোলাম আজমকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়।
জাতীয় সংসদের পঞ্চম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দানসহ সংবিধানে এর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা হয় জিয়ার আমলে। এরৎ ফলে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক বাহিনীর একটি গ্রুপের আক্রমণে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া নিহত হন। উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুর সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী প্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। দেশে সামরিক শাসন জারি করেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বহাল ছিল। ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে এরশাদের ওই সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইন বলবৎ থাকাকালীন সময়ে প্রণীত সব ফরমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, নির্দেশ ও অধ্যাদেশসহ অন্যান্য আইন অনুমোদন দেওয়া হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে।
৬ ডিসেম্বর তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ সরকার পদত্যাগ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৯১ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি বিজয় অর্জন করে। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্টের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংশোধীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়, শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবার সংকটে পড়ে। এরপর আওয়ামী লীগ জামাতের সাথে কৌশলগত ঐক্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে এবং ১৭০ দিন সমাবেশ, বিক্ষোভ, ধর্মঘট, হরতাল ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচন করে। বিএনপি ওই পার্লামেন্টে ১৯৯৬ সালে ২৭ মার্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার বিল পাস করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালে বিডিআর-এর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এবং ক্ষমতাকেন্দ্রে একটি ঝাকুনির সৃষ্টি হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান আইন ২০১১ পাস হয়। ৩০ জুন ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পুনর্বহাল ও সংযোজন করা হলেও, এই সংশোধনী দ্বারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। যা রাজনীতিতে গভীর সংকট ও অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। এই অচল অবস্থা থেকে দেশ এখনো মুক্ত হয়নি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। দেশে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী একনায়কের জন্ম হয়।
কোটা আন্দোলনের পটভূমিতে ৫ আগস্ট ২০২৫ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল, গণতন্ত্র কায়েম ও বৈষম্যবিরোধিতা। ৫ আগস্টের পর ’৭২-এর সংবিধান বাতিল, সংবিধানের পুনর্লিখন, চার মূলনীতি বাতিলের দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতারা। কিন্তু জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের দাবিতে ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিলের দাবি ছিল না। এই দাবি দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়াশীল দাবি, যা আন্দোলনে বিতর্ক ও বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কারণে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এই সুযোগে ’৫২ ও ’৭১-এর অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনাকে পাল্টিয়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার তৎপরতা চালাচ্ছে। তাই তারা জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন করতে এবং জুলাই সনদকে সংবিধানের উপরে স্থান দিতে চায়। সেই সনদকে সংসদ বা আদালতে কোথাও চ্যালেঞ্জ করা যাবে না–এই বিধান যুক্ত করতে চায়।
গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় নীতিতে সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও তার উত্থান কিভাবে হলো, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রণীত সংবিধানে বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে কিভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ করে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে, তা বোঝার স্বার্থে– আমি ইতিহাসের মূল বাঁকগুলো আমার লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করেছি। যা বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে এবং ভবিষ্যত পথচলায় সহায়ক হবে বলে মনে করি।
বুর্জোয়া রাজনীতিক দেউলিয়াত্ব বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপির ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রাজনীতিকে ব্যবহার এবং বামপন্থি প্রগতিশীল রাজনীতিতে ভাঙন, বিভক্তি, সুবিধাবাদ ও হঠকারিতা– জামাতসহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। জামাত আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগতভাবে বর্তমানে খুবই সুসংগঠিত দল যা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে। জনগণের সামনে তাদের শক্তি দৃশ্যমান হচ্ছে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ীদের দল। কিন্তু জামাত দলগতভাবে একটি ব্যবসায়ী দল। বর্তমান অবাধ-মুক্তবাজার নীতির সবচেয়ে লাভবান-সুবিধাভোগী দল হলো জামাত। অর্থনীতিতে এই দল রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। বর্তমানে ক্ষমতায় যাওয়ার দরজায় কড়া নাড়ছে এই দল। যদিও এই দল শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দল আর শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের স্বার্থবিরোধী দল। তাই এই দলের পক্ষে এ দেশের গণমানুষকে মুক্তির দিশা দেওয়া সম্ভবপর নয়। নির্বাচনকে বিলম্বিত করাই এই দলের কর্মকৌশল। সময়ই এই দলকে একদিন গণতন্ত্র ও গণবিরোধী দল হিসেবে সামনে নিয়ে আসবে। তাই ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, গণতন্ত্রহীনতাই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতিয়ার।
লেখক : সভাপতি, সিপিবি, কেন্দ্রীয় কমিটি