দাসতন্ত্রের ওপর মার্কসীয় অর্থনীতির আলোকপাত

Posted: 27 সেপ্টেম্বর, 2020

আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থাকে সরিয়ে সমাজে দাস-মালিক ব্যবস্থা এসেছিলো। সেটা ছিলো মানুষের ওপর মানুষের শোষণভিত্তিক সর্বপ্রথম উৎপাদন-প্রণালী। দাসপ্রথার ভিত্তি ছিলো উদ্বৃত্ত-উৎপাদিত দ্রব্য। ফসল চাষ, গবাদি পশুপালন, মাছ মারা, শিকার এবং অন্যান্য কাজে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দ্রব্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। ফলে অতিরিক্ত দ্রব্য থেকে যায় প্রয়োজন মিটিয়ে। আর একটি বিষয় হলো ইতোপূর্বে যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করা হলেও এখন আর তা করা হয় না, লাভের লক্ষ্যে তাদের দাস হিসেবে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। দাসপ্রথা প্রথমে আত্মপ্রকাশ করেছিলো পিতৃতান্ত্রিক দাসপ্রথা রূপে। মুক্ত জাতিদের পাশাপাশি আঞ্চলিক সংঘের মধ্যে কিছুসংখ্যক দাস অন্তর্ভুক্ত ছিলো। প্রাথমিক পর্যায়েই দাস-শ্রম দাস-মালিকদের সম্পদশালী করতে সাহায্য করেছিলো। এর ফল ছিলো বৈষয়িক অসাম্য বৃদ্ধি। তখন যুদ্ধবন্দিদের পাশাপাশি নিজেদের উপজাতিভুক্ত লোকদের ঋণের দায়ে দাস বানানো হতো। বিভিন্ন শ্রেণি ও বৈষয়িক অসাম্য বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দাসদের বশে রাখার প্রয়োজন পড়ে। নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি এবং পাহারা দেয়ার আবশ্যকতা থেকে দাস-মালিকরা বিশেষ বিশেষ সংস্থা গড়ে তোলে। এই সংস্থাগুলো শোষিতদের ওপর একত্রে ছিলো বলপ্রয়োগের হাতিয়ার। এর থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির সূচনা। ভারত, চীন, মিশর, ব্যাবিলোনিয়া, সিরিয়া, পারস্য প্রভৃতির মতো প্রাচ্যের দেশগুলোতে দাসপ্রথার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিলো। এসব সমাজে বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে জমি ও উৎপাদনের উপকরণের ওপর এবং দাসদের উপরেও দাস-মালিকদের মালিকানা ব্যক্তিগতের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ছিলো যৌথ। মালিকানা ছিলো সম্প্রদায়গত, মন্দির ও রাষ্ট্রের সম্পত্তির মতো। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি থাকতো কোনো স্বৈরাচারি শাসক। সে শোষণ করতো মুক্ত গ্রামীণ জনগণকে, আঞ্চলিক সংঘের সদস্যদের। তাদের ওপর প্রচণ্ড কর ও শুল্ক ধার্য হতো। তাদের অবস্থান দাসদের চেয়ে খুব একটা ভালো ছিলো না। এই দেশগুলোতে দাস-শ্রম অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা পালন করেনি। দাসদের সদস্য সংখ্যাও বিরাট ছিলো না। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে পিতৃতান্ত্রিক দাসপ্রথা ক্রমবিকশিত হয়ে পরিণত হয়েছিলো ক্লাসিক্যাল দাসপ্রথায়। সেখানে দাস-শ্রম হয়ে ওঠেছিলো উৎপাদন ও সমাজের উৎপত্তির ভিত্তি। এসব দেশে দাস-মালিক উৎপাদন-প্রণালীর উৎপত্তি হয়েছিলো সেখানকার উৎপাদিকা শক্তিগুলোর বিকাশ এবং সামাজিক শ্রম বিভাজন দিয়ে। এর সাথে জড়িত ছিলো দাস ও জমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার সম্প্রসারণ। এর পেছনে আরো কাজ করেছিলো পণ্য-অর্থ সম্পর্কের বিকাশ। দাস-মালিক রাষ্ট্রগুলোতে বিকশিত হয়েছিলো বিজ্ঞানের বহু শাখা, যেমন- বলবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, স্থাপত্য প্রভৃতি। সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছিলো সাহিত্যকর্ম, ভাস্কর্যকর্ম, ও অন্যান্য শিল্পকর্ম দিয়ে। এখানে বলার মতো একটা বিষয় হচ্ছে ইউরোপীয় সভ্যতা পৃথিবীতে প্রাচীনতম নয়। বর্তমান ইউরোপীয় জাতিগুলোর পূর্বপুরুষরা যখন আদিম সাম্যবাদী সমাজে বাস করছিলো তখন মিসর, ভারত, চীন, ও মেসোপোটেমিয়ার ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। দাস-মালিক উৎপাদন-সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য ছিলো উৎপাদনের উপকরণের সাথে শ্রমশক্তির সুনির্দিষ্ট এক সংযোগ-রীতি। দাস- শ্রমিক উৎপাদনের উপকরণ থেকে বঞ্চিত ছিলো। শুধু তাই না তারা নিজেরাই ছিলো দাস-মালিকের সম্পত্তি। দাস-মালিক তাদের কাজ করতে বাধ্য করতো। আর তাদের শ্রমের ফলে উৎপাদিত সামগ্রী আত্মসাৎ করতো। তবে তাদেরকে সামান্য একটা অংশ দিতো শুধু বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে যাতে ফের খাটানো যায়। দাসকে দেখা হতো একটা বস্তু হিসেবে- মানুষ হিসেবে নয়। গবাদি পশুর মতো দাস কেনা-বেচা হতো। অথবা মালিকের ইচ্ছে হলে হত্যাও করতে পারতো। প্রাচীন রোমে কারিগরি উপকরণকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছিলো, যেমন - কথা বলা দাস, হাম্বা ধ্বনির পশু এবং শব্দহীন কাজের বস্তু। দাসকে মালিকের নামলেখা একটা দড়ি গলায় পরে থাকতে হতো। দাসদের গায়ে একটা ছাপ মেরে দেয়া হতো যাতে পালিয়ে গেলে সহজে সনাক্ত করা যায়। তখনকার সময় দাসদের ওপর চলতো শারীরিক বলপ্রয়োগ। সে অবস্থায় তাদের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কোনো অনুপ্রেরণা ছিলো না। শ্রমের উপকরণগুলো ছিলো স্থূল এবং আদিম প্রকৃতির। মানবজাতির ইতিহাসে দাসপ্রথা ছিলো প্রথম সরাসরি পাশবিক শোষণের রূপ। উদ্বৃত্ত-সামগ্রীর পরিমাণ বাড়ানোর জন্য দাস-মালিকরা দাস-শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়াতো। দাস সংগ্রহের প্রধান উৎস ছিলো রাজ্য জয়ের যুদ্ধগুলো। দাস-সমাজের বৈশিষ্ট্য ছিলো জীবনধারণের উপযোগী উৎপাদন করা। সেখানে বেশিরভাগ সামগ্রীই গার্হস্থ্য প্রয়োজন মেটাতো। উদ্বৃত্ত-সামগ্রীর অধিকাংশ ব্যবহৃত হতো অনুৎপাদনশীলভাবে। সেটা ব্যবহৃত হতো দাস-মালিকদের ব্যক্তিগত ভোগে। যেমন- সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ, মন্দির নির্মাণ, ভোজ উৎসবে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং খেলাধুলায়। তাই দাস-মালিক উৎপাদন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিলো দাস-মালিকদের পরগাছাসুলভ চাহিদাগুলো বেশি বেশি মাত্রায় পূরণ করা। সেই লক্ষ্য অর্জিত হতো প্রত্যক্ষ শারীরিক বলপ্রয়োগের দ্বারা। ক্রীতদাসদের ওপর চালানো হতো এক নির্মম শোষণ। এটাই ছিলো দাস-মালিক সমাজব্যবস্থার মূল অর্থনৈতিক নিয়মের সারকথা। এক সময়ে দাস-শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত-সামগ্রী আত্মসাৎকারী দাস-মালিকরা এর একটা অংশ বাজারে ছাড়তে লাগলো। দাস কেনা-বেচা হতে লাগলো বেশি বেশি। ক্ষুদ্র উৎপাদক কৃষক ও হস্তশিল্পী তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের এক অংশ বাজারে বেচতো। গ্রিস, রোম, ভারত ও চীনে বিভিন্ন কর্মশালা, কামারশালা, বেকারি থেকে উৎপাদিত দ্রব্য-সামগ্রী ও অন্যান্য হস্তশিল্প বাজারে বেচতো। তাই পণ্য-বিনিময় ক্রমশ বিকশিত হয়ে পরিণত হলো নিয়মিত ব্যবসা-বাণিজ্যে। বাজারে সক্রিয় কেনা-বেচা চলতে লাগলো। বাণিজ্য প্রসারিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করলো। বাণিজ্য রূপ নিলো বৃহদায়তন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। এতে অংশ নিলো চীন, গ্রিস, রোম, মিশর, ব্যাবিলোনিয়া প্রভৃতি দাস-মালিক রাষ্ট্র। সামাজিক শ্রম বিভাজন গভীর হয়ে উৎপাদন বাড়তে থাকায় পণ্য-অর্থ সম্পর্কও পাল্লা দিয়ে বিকশিত হতে থাকে। পণ্য-অর্থ সম্পর্ক ও বাণিজ্যের বিকাশের ফলে দেখা দিয়েছিলো পুঁজির প্রথম ঐতিহাসিক রূপগুলো যথা- বণিকের পুঁজি, সুদখোরের পুঁজি। বণিক শ্রেণির উদ্ভব ছিলো তৃতীয় বড় ধরনের শ্রম বিভাজন। পণ্যসামগ্রী বিনিময়ে বণিকরা কাজ করতো মধ্যবর্তী হিসেবে। পণ্যসমাগ্রী বিনিময়ে তারা মুনাফা করতো কম দামে কিনে বেশি দামে বেচে এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে। আর সুদখোররা দাস-মালিকদের, ক্ষুদ্র উৎপাদকদের, কৃষকদের ও হস্তশিল্পীদের চড়া হারে অর্থ ধার দিতো। সুদ হিসেবে এরা হাতিয়ে নিতো দাস-মালিকসহ অন্যসব উৎপাদকদের উদ্বৃত্ত-সামগ্রী। আর দাস-মালিকদের উদ্বৃত্ত-সামগ্রী সৃষ্টি হতো মূলত ক্রীতদাসদের হাড়ভাঙা নির্মম শ্রমে। বণিকের পুঁজি ও সুদখোরের পুঁজি দাস-মালিক ব্যবস্থায় পণ্য উৎপাদনের বিকাশ ঘটিয়েছিলো। এই পুঁজি সে সমাজের মৌলিক প্রাকৃতিক অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছিলো। দাস-মালিকের লোভ সে জন্য দায়ি এবং তা দাসদের ওপর শোষণ-নির্যাতন ব্যাপক বৃদ্ধি করেছিলো। এ ব্যবস্থায় উৎপাদন ও বিনিময়ের বিকাশ বৈষয়িক অসাম্য বাড়িয়েছিলো। এই বিকাশ কারো ভাগে সম্পদ বাড়িয়েছিলো আর কারো ক্ষেত্রে ঋণ বাড়িয়ে সর্বনাশ ডেকে এনেছিলো। দাস ব্যবসায় হয়ে উঠেছিলো সবচেয়ে মুনাফাদায়ক। দাস-ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা দাস বাজারের বড় বড় কেন্দ্রে সমবেত হতো দেশ-বিদেশ থেকে এসে। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ এবং ইতিহাসবিদগণ প্রাচীন দাস-মালিক সমাজের ইতিহাসকে বিকৃত ও সংস্কার করতে চেষ্টা করেন। পুঁজিবাদী সম্পর্কের চিরকালীন প্রকৃতি প্রমাণ করার জন্য তারা প্রাচীন রোম ও গ্রিসে পুঁজিবাদের উপাদানগুলোর সন্ধান করেন। সমাজের বিকাশে দাসপ্রথা ছিলো এক আবশ্যিক পর্যায়। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থার তুলনায় তা ছিলো বড় একটা অগ্র পদক্ষেপ। দাসপ্রথা উপকরণ নির্মাণে, উৎপাদনের বিশেষীকরণে এবং সুগভীর সামাজিক শ্রম বিভাজনে উন্নতি ঘটিয়েছিলো। ঘটিয়েছিলো উচ্চতর শ্রম উৎপাদনশীলতা। সে সময়েই সর্বপ্রথম শহরগুলো বাণিজ্য ও হস্তশিল্পের কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। শহরগুলো হয়ে ওঠেছিলো বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রাণকেন্দ্র। আর সেই প্রাচীন সভ্যতার ভিত্তি ছিলো বিপুল সংখ্যক দাসদের অনেক জেনারেশনের হাড়ভাঙা শ্রম। দাস-মালিক প্রথার মাঝে ছিলো অনেক অমীমাংসেয় আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। প্রধান দ্বন্দ্ব ছিলো দাস ও দাস-মালিকদের মধ্যে স্বার্থ সংক্রান্ত। এই দ্বন্দ্ব শেষমেষ দাস-মালিক সমাজের পতন ঘটিয়েছিলো। প্রণোদনাহীন গোলামসুলভ দাসশ্রম শেষ পর্যন্ত দাসভিত্তিক উৎপাদনের ব্যাঘাত এবং ক্ষয় ঘটিয়েছিলো। দাসশ্রমকে ব্যবহার করা হতো অতি শোষণমূলকভাবে। ব্যবহার করা হতো অনুৎপাদনশীলভাবে। তখন কায়িক শ্রমকে একজন মুক্ত নাগরিকের জন্য মর্যাদাহানিকর বলে গণ্য করা হতো। কঠোর কায়িক শ্রম ছিলো শুধু দাসদের জন্য নির্ধারিত। অন্যপক্ষে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ, রাজনীতি, দর্শন, শিল্পকলা ও সাহিত্য সাধনা ছিলো দাস-মালিকদের বিশেষ অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এজন্যই এ দুয়ের শ্রেণি-চরিত্র ছিলো আলাদা। দাসপ্রথার বিরোধমূলক দ্বন্দ্বগুলো শহর এবং গ্রামের মধ্যে বিপরীতভাব প্রকাশ করেছিলো। শহরগুলো ছিলো হস্তশিল্প, বাণিজ্য, সুদবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আর কৃষি উৎপাদনে অনগ্রসর ধরনের ছিলো গ্রামগুলো। গ্রামে আদিম ব্যবস্থার বহু বৈশিষ্ট্য বজায় ছিলো। শহরগুলো গ্রামকে শোষণ করতো নানাভাবে। যেমন- কৃষিজাত সামগ্রী কিনতো কম দামে এবং শহুরে সামগ্রী বেচতো বেশি দামে। তারা গ্রাম থেকে বহু ধরনের কর ও শুল্ক আদায় করতো। মুক্ত কৃষকদের যুদ্ধ জয়ের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে বাধ্য করতো। এসব কারণে গ্রামগুলো দরিদ্র হচ্ছিলো এবং কৃষির অবনতি ঘটছিলো। এভাবেই দাসপ্রথার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছিলো। দাস-মালিক সমাজের আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিলো বৃহদায়তন ও ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের দ্বন্দ্ব। বৃহদায়তন উৎপাদন ছিলো দাসভিত্তিক। আর ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন ছিলো মুক্ত কৃষক ও হস্তশিল্পীদের উৎপাদন। দাস-শ্রমে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি হতো অপেক্ষাকৃত কম দামে। কারণ দাসদের সস্তায় ভরণপোষণ করা যেতো বলে তাদের শ্রমে উৎপাদন খরচ কম হতো। ক্ষুদ্র কৃষক আর হস্তশিল্পীরা দাস-চালিত বড় বড় উদ্যোগের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারতো না। এরা সর্বস্বান্ত হয়ে যেতো। কর বৃদ্ধি, ঋণে আবদ্ধ হওয়া, দাস-মালিক দ্বারা তাদের সম্পত্তি দখল এবং যুদ্ধের কঠিনতা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দ্রুত পথে বসিয়ে দিতো। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সর্বনাশের ফলে দাস-মালিক রাষ্ট্রগুলোতে বিশেষ করে রোমে অনেক বিত্তহীন ও ছিন্নমূল মানুষ দেখা দিয়েছিলো। এরা উৎপাদনের উপকরণ থেকে বঞ্চিত হয়ে উৎপাদন থেকে ছিটকে পড়েছিলো। এরা শহরের পথে পথে ভিড় করে খাবার দাবি করতো। এদের ভরণপোষণ করতে বাধ্য হতো দাস-মালিক রাষ্ট্র, কারণ এরা ব্যক্তিগতভাবে মুক্ত ছিলো বলে উৎপাদনশীল শ্রমকে পছন্দ করতো না। এদের বাঁচানো হতো দাসদের উদ্বৃত্ত শ্রমের বিনিময়ে। রোমে এই ধরনের লোকদের বলা হতো লুম্পেন প্রলেতারিয়েত। মুক্ত কৃষক ও হস্তশিল্পীদের রোম ও অন্যান্য দাস-মালিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাকে দুর্বল করেছিলো। কারণ ক্ষুদ্র উৎপাদকরাই ছিলো সামরিক ক্ষমতার মূল। ফলে রাজ্যজয়ের যুদ্ধ পরিণত হলো আত্মরক্ষার যুদ্ধে। জয়ের জায়গায় ঘটতে লাগলো পরাজয়। অন্যদিকে সস্তা দাসদের উৎসটি নিঃশেষ হয়ে যেতে শুরু করলো। বড় বড় দাসভিত্তিক উদ্যোগে সস্তা দাসদের পাইপ লাইন ক্ষীণ হয়ে আসায় দাসদের দাম বেড়ে গেলো পূর্বের তুলনায়। ফলে দাসশ্রমে উৎপাদন কমে গেলো। কৃষি ও হস্তশিল্পের অবনতির কারণে বাণিজ্য থমকে দাঁড়ালো। শহরের জনসংখ্যা সংকুচিত হলো। শহরগুলো ক্ষয় পেতে শুরু করলো। শহরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব নষ্ট হলো। দাস-মালিক প্রথার ভাঙনের সাথে জড়িত ছিলো উৎপাদিকা শক্তিগুলোর ব্যাপক বিনাশ। বৃহদায়তন দাসভিত্তিক উৎপাদন সংকটে পতিত হলো। এই সিস্টেম থেকে ক্রমে আয় কম হতে লাগলো। ফলে জমির বড় বড় খণ্ডকে ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করাটা লাভজনক হয়ে উঠলো। নির্দিষ্ট শর্তে সেই টুকরোগুলো মুক্ত নাগরিকদের মাঝে বা দাসদের কাছে ইজারা দেয়া শুরু হলো। নতুন কৃষি শ্রমিকরা জমির টুকরোর সাথে বাঁধা থাকতো। জমির সাথে তাদের বিক্রি করা যেতো। এরা গঠন করেছিলো পণ্য উৎপাদকদের এক নতুন বর্গ। তারা দাস আর মুক্ত নাগরিকদের মাঝামাঝি এক মধ্যবর্তী অবস্থান দখল করেছিলো। তারা পরিচিত ছিলো ‘কলোনি’ নামে। তারাই ছিলো মধ্যযুগের ভূমিদাসদের পূর্বপুরুষ। এভাবে ক্ষুদ্রায়তন কৃষকভিত্তিক উৎপাদনই হয়ে ওঠলো অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ধরণ, যা ছিলো মিতব্যয়ী এবং স্বনির্ভর। দাসভিত্তিক উৎপাদনের অবনতি ও তার দ্বন্দ্বসমূহের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রেণি-সংগ্রাম জমাট বাঁধলো। দাসদের বিদ্রোহ হলো, অনেক অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো আর সেগুলো একাত্মতা প্রকাশ করলো নিপীড়িত কৃষক ও হস্তশিল্পীদের লড়াইয়ের সাথে। ইতিহাসে বহু দাস বিদ্রোহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ইউনুস ও ক্লিউনের নেতৃত্বে সিসিলি দ্বীপে বিদ্রোহ, এরিস্টোনিকাসের নেতৃত্বে এশিয়া মাইনরে বিদ্রোহ, চীনে ‘রক্তিম ভ্রূ’ বিদ্রোহ, সাউমাকুসের নেতৃত্বে বস্পোরাস রাজ্যেবিদ্রোহ এবং ইতালিতে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান। দাসদের অভ্যুত্থানগুলো দাস-মালিক রাষ্ট্রগুলোর ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেগুলো প্রতিবেশী উপজাতি এবং জাতিগুলোর সশস্ত্র আক্রমণের সাথে মিলে গিয়েছিলো। রোমান সাম্রাজ্য জার্মান, গালিক, স্লাভ ও অন্যান্য বর্বর উপজাতির আঘাতে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। দাসপ্রথার পতনে দাস ও দাস-মালিক এই দুই বৈরী প্রধান শ্রেণি লোপ পেয়েছিলো। এর অর্থ এই নয় যে মানুষের ওপরে মানুষের শোষণের অবসান ঘটেছিলো। দাসপ্রথার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলো সামন্ততন্ত্র। এই সমাজব্যবস্থার অধীনে শোষণ আরো নতুন নতুন রূপ নিয়েছিলো। আবার উৎপাদিকা শক্তিগুলোর বিকাশের অধিকতর সুযোগ এনে দিয়েছিলো। দাস-মালিক প্রথা লোপ পেলেও এর জের ও অবশেষগুলো বহুকাল সমাজে থেকে যায়। ১৬শ শতাব্দির শেষ দিকে আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ আফ্রিকানকে জোরপূর্বক আমদানি করা হয়েছিলো বাগান ও খনিতে দাস হিসেবে কাজ করতে। ১৬৮০ থেকে ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ বণিকরা ২০ লক্ষের বেশি দাস চালান দিয়েছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে। ১৯শ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স ও হল্যান্ডের উপনিবেশগুলোতে দাস ব্যবসা চলেছিলো আর বাগানগুলোতে ছিল দাস-শ্রমের ব্যাপক ব্যবহার। ১৮৬১-৬৪ সালে গৃহযুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা আইনগতভাবে বিলুপ্ত হয়েছিলো। তারপরেও কৃষ্ণাঙ্গরা থেকে গিয়েছিলো জনসমষ্টির সবচেয়ে অধিকারহীন ও নিপীড়িত অংশ। বাগানে দাসপ্রথা ও পিতৃতান্ত্রিক দাসভিত্তিক সম্পর্কের জের এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কিছু কিছু দেশে বিদ্যমান থাকে। এই জেরগুলোর মধ্যে পড়ে ঋণশোধের জন্য দিনমজুরি, অনৈচ্ছিক বৈশ্যতার প্রথা। পুঁজিবাদী দেশে বর্ণবাদ হলো দাস-মালিক প্রথার জের। আজকের দিনের পুঁজিবাদী সমাজ দাসপ্রথার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে মানসিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যে বৈপরীত্য। শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈপরীত্য। সেই বৈপরীত্য শুধু বজায় থাকেনি নতুন নতুন রূপে জটিল হয়েছে। কায়িক শ্রমের প্রতি শোষকদের বিতৃষ্ণার উৎস সন্ধান করা যায় সেই দাসপ্রথার মধ্যে। আজকে প্রগতির পথে সংঘটিত সংগ্রামই কেবল পারে পশ্চাৎপদ সব জেরকে সমূলে উৎপাটন করতে। লেখক : কলামিস্ট