আমৃত্যু লড়াকু কমরেড আজাদ মাস্টার

Posted: 24 মে, 2020

আবু সায়েম : কমিউনিস্ট পার্টি বা বিভিন্ন গণসংগঠন করতে গিয়ে আমরা কতবারই না শপথ গ্রহণ করি। সংগঠনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার কিংবা আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় শপথ নিই আমরা। শপথ নিতে নিতে যৌবনে অধিকাংশ কমিউনিস্টই হয়ত মনের মধ্যে স্বপ্ন বুনে সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার। বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই হয়ত সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সেই স্বপ্ন হয়ত সত্যিও হয়। যেমনটা হয়েছে কমরেড আজাদ মাস্টারের ক্ষেত্রে। পার্টির মানববন্ধনে যোগ দিয়ে বুকে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকে সংগঠনের দায়িত্ব পালন করার পর বাড়ি ফেরার পথে যিনি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। “জেলায় জেলায় করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা কর” লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা তার জীবনের শেষ ছবিটা আজও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে আর তার দাবিকে আরো যৌক্তিক করে তুলছে। যে ছবিটা কিনা তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে তোলা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটির অন্যতম সদস্য ও কৃষক সমিতি ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন কমরেড আজাদ মাস্টার। একজন যুক্তিবাদী কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা হিসেবে যিনি ছিলেন এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর মত বিনয়ী সুবক্তা কমরেড পার্টিতে পাওয়া বড়ই কঠিন। মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ার কারণে চরম এক বৈরিতার মধ্যেও শুধুমাত্র গভীর জ্ঞান ও তীক্ষ্ণ যুক্তিসম্পন্ন মানুষ হওয়ায় জীবনের ২০ থেকে ২৫ বছর নিরলসভাবে দায়িত্বের সাথে কমিউনিস্ট পার্টি করে গেছেন এই মানুষটি। কমিউনিস্ট পার্টি করার কারণে প্রায়শই মাদ্রাসার সহকর্মী শিক্ষকসহ ম্যানেজিং কমিটির লোকজনের বিভিন্ন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে তাকে। একজন মাদ্রাসার শিক্ষক হয়ে কেন তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করেন- এই প্রশ্ন যে জীবনে কতবার শুনতে হয়েছে তাকে তার কোনও হিসাব হয়তো নেই। কিন্তু তাঁর নীতি-আদর্শ ও চরম দায়িত্বশীল আচরণের কারণে একসময় প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া মানুষগুলোই আবার বাধ্য হয়েছে তাকে ‘জনদরদি কমরেড আজাদ মাস্টার’ নামে ভূষিত করতে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সবসময় সরব থাকতেন তিনি, কিন্তু কখনই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে কাউকে কিছু বলেননি। একজন ভালো কমিউনিস্ট হলে যে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ভালো মানুষ হওয়া যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন কমরেড আজাদ মাস্টার। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বুকে নিয়ে যেমন পার্টির লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন তেমনই একজন কৃষক হয়ে ফসলের ন্যায্য মূল্যসহ কৃষকের নানা দাবিতে ছিলেন সব সময় সোচ্চার। কৃষক সমিতি পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্বে থেকে কৃষক নেতা কমরেড মনসুরুল আলমের ঘনিষ্ট সহযোগী হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এলাকার বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনে। মানব সেবা ছিল তার নেশা ও পেশা। শিক্ষকতার পাশাপাশি পল্লী চিকিৎসক হিসেবেও তিনি এলাকার গরিব দুঃখী মানুষজনকে র্দীঘদিন সেবা দিয়েছেন। মানুষের সেবা করার প্রবল ইচ্ছা শক্তি নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে পীরগঞ্জের ১০ নম্বর জাবরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে একবার নিবার্চনও করেছিলেন কমরেড আজাদ মাস্টার। সমাজসেবক হিসেবে অত্যন্ত সুনাম ছিল তার। এলাকার মানুষের যেকোনও ধরনের সুখ ও দুঃখে সব সময় পাশে থাকতেন তিনি। ন্যায় বিচারক হিসেবে এলাকায় তিনি ছিলেন খুবই গ্রহণযোগ্য। তাঁর নিজ গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামেও বিচার সালিশ হলে তার ডাক পড়তো। অনেক ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান মেম্বাররা যেই ঝগড়া বিবাদের সমাধান দিতে পারতেন না সেই ঝগড়া বিবাদের সমাধান দিতেন কমরেড আজাদ মাস্টার। কমিউনিস্ট হিসেবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করার শপথ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তিনি। বর্ষীয়ান রাজনীতিক কমরেড মনসুরুল আলমের হাত ধরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। রাজনৈতিক গুরু মানতেন যে মনসুরুল আলমকে সেই মনসুরুল আলমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন ১১ মে ২০২০ তার স্মরণসভায় অংশগ্রহণ সেই সাথে চিকিৎসা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সিপিবি পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটির আয়োজনে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ শেষে মোটরসাইকেল যোগে বাড়ি ফেরার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন আমৃত্যু লড়াকু কমরেড আজাদ মাস্টার। তার এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিপিবি পীরগঞ্জ উপজেলার সকল সদস্যের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। যিনি কিছুক্ষণ আগেই স্মরণসভায় বক্তৃতা করলেন প্ল্যাকার্ড বুকে নিয়ে একই সাথে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন সেই মানুষটি এখন আর তাদের মাঝে নেই। এটা যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণে ১০নং জাবরহাট ইউনিয়নের করনাই গ্রামে ১৯৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কমরেড আজাদ হোসেন মাস্টার। তার পিতা মৃত গণি মন্ডল ছিলেন একজন মধ্য কৃষক । ১৯৭৮ সালে পার্শ্ববর্তী দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার ধুকুরঝারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি ও ১৯৮০ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে কেয়ার, আর ডি আর এস’সহ কয়েকটি এনজিওতে চাকুরি করেন। এরপর কিছুদিন জগন্নাথপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৯ সালে নিজ গ্রামে করনাই হাটপাড়া ফাজিল মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। গত ১১ মে সিপিবি পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটির সাবেক সভাপতির স্মরণ সভা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন আমৃত্যু বিপ্লবী এই কমরেড। কমরেড আজাদ মাস্টার লাল সালাম। লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটি