দমন-পীড়নে শ্রমিকবিক্ষোভ থামানোর চেষ্টা
একতা প্রতিবেদক :
গুলি করে শ্রমিক হত্যা, ডজন ডজন মিথ্যা মামলা, শতাধিক শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার, আরো অনেকের পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার পরে নিখোঁজ হওয়া এবং হাজার হাজার শ্রমিকের চাকুরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে দৃশ্যত থামিয়ে দেয়া হয়েছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিক্ষোভ। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গত কয়েক বছর ধরে চলা শ্রমিকদের আন্দোলন গত দুই সপ্তাহে শিল্পাঞ্চলসমূহে শ্রমিক বিক্ষোভে রূপ নিয়ে জ্বলে উঠেছিল। যারা শ্রমিক ও শিল্পের খবর সাধারণভাবে রাখেন না, তারা এ কয়দিনে কিছুটা হলেও জেনেছেন পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় করে সবচেয়ে কম মজুরি পাওয়া শ্রমিকদের অতি সামান্য মজুরিতে আরো কত ফাঁকি থাকে।
গত ১৭ জানুয়ারি গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, নিখোঁজদের সন্ধান, চাকুরিচ্যুতদের পুনর্বহাল এবং ছাঁটাই-দমন-পীড়ন বন্ধের দাবিতে অনুষ্ঠিত শ্রমিক সমাবেশে গার্মেন্ট শ্রমিক টিইউসির সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেছেন শ্রমিকদের ওপর দমন পীড়ন অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। সরকার ও মালিকদের চরম দমন-পীড়নে বিক্ষোভ আপাতত থামিয়ে দেয়া হলেও শ্রমিক অসন্তোষ থেকেই গেল। বরং মজুরি না বাড়িয়ে আন্দোলন দমনে শ্রমিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতন শ্রমিকদের চাপা ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ফলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, শ্রমিকদের জমে থাকা ক্ষোভ নিকট ভবিষ্যতে আকস্মিক বিদ্রোহ রূপে প্রকাশ পাবে।
মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকরা অপেক্ষা করে আছে প্রায় তিন বছর। এই দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন কাঙ্ক্ষিত মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণাটি এলো তখন দেখা গেল মজুরি বৃদ্ধি দূরের কথা বাস্তবে মজুরি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। কারখানার ৮০ ভাগ শ্রমিক অপারেটর। ২০১৩ সালে অপারেটরের বেসিক মজুরি নির্ধারিত হয় ৩৮০০ টাকা, সেই মজুরি কাঠামো অনুসারে প্রতি বছর শ্রমিকের মজুরি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ২০১৮ সালে অপারেটরের বেসিক মজুরি ছিল ৪৭৪১ টাকা। নতুন মজুরি কাঠামোতে দেখা গেল অপারেটরের মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ৪৯৩০ টাকা, অর্থাৎ শ্রমিকের বেসিক মজুরি বৃদ্ধি পেল ১৮৯ টাকা। কিন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে সরকার এই মজুরি বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি না করলে সাধারণভাবে জানুয়ারি মাসে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পেত ২৩৭ টাকা। অথচ মালিকরা ব্যাপকভাবে প্রচার চালান শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন ২৭০০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। গার্মেন্ট টিইউসিসহ শ্রমিক সংগঠনসমূহের তীব্র আপত্তি অগ্রাহ্য করে সরকার ও মালিকরা মিলিতভাবে এই প্রতারণাপূর্ণ প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এবছরের প্রথম মাসে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে গেলে মজুরি বৃদ্ধির হিসাব মালিকপক্ষ হাতে কলমে শ্রমিকদের বোঝাতে ব্যর্থ হন। দেখা গেল চিকিৎসা ভাতা ২৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ২০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৬৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা এবং বাড়ি ভাড়া পূর্বে বেসিক মজুরির ৪০ শতাংশ ছিল যা ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে তাদের সর্বমোট মজুরি হাজার বারোশ টাকা বৃদ্ধি পেলেও বেসিক মজুরি এবং ওভার টাইম হার কমে গেছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সরল প্রশ্ন ছিল, যদি সর্বনিম্ন ২৭০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি হয়ে থাকে তাহলে গত মাসের চেয়ে এই মাসে তাঁরা অন্তত ২৭০০ টাকা বেশি মজুরি পাবে না কেন? মাত্র কয়েকশ টাকা মজুরি বৃদ্ধির জন্য কি তাঁরা এত দিন অপেক্ষা করেছে? এছাড়াও অপারেটর পদবীটিকে সাধারণ, জুনিয়র, সিনিয়র ইত্যাদি মোট চারটি গ্রেডে ভাগ করা এবং কোনো গ্রেডে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে শ্রমিকের অভিজ্ঞতার সময়সীমা সুনির্দিষ্ট না থাকায় শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে গ্রেড চুরির শিকার হন।
জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যখন শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে আসে তখন থেকেই আন্দোলন দমন করার কৌশল গ্রহণ করে সরকার। গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন এখন অতীত যুগের চেয়ে অনেক পরিপক্ক। ভাংচুর এবং ধ্বংসাত্মক কাজের দায় শ্রমিকদের ওপর চাপানোর সুযোগ মালিকরা বলতে গেলে এখন পায়ই না। তার পরেও শ্রমিকদের আন্দোলন দমনে এ লেখার পূর্ব পর্যন্ত সাভার ও আশুলিয়া থানায় মামলা হয়েছে অন্তত ১২টি এবং এসব মামলায় কমপক্ষে ৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনাবাড়ি থানার একটি মামলায় রেজাউল এপারেলস লি. কারখনার শ্রমিক ও গার্মেন্ট টিইউসির কারখানা কমিটির নেতা ইয়াসিন আরাফাত, হাবিবুল্লাহ ও আমিনুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তরা এলাকার বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে, সেসব মামলায় শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসকল মামলায় কয়েক হাজার শ্রমিককে নামে বেনামে আসামী করা হয়েছে। গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ১৪ জন কারখানা পর্যায়ের শ্রমিকনেতা নিখোঁজ ছিলেন, যাদের গভীর রাতে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে পরবর্তিতে ৪ জনকে আদালতে এবং একজনকে দক্ষিণখান থানায় পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত অন্তত নয়জন নিখোঁজ শ্রমিকের সন্ধান মেলেনি। গ্রেফতার হয়েছেন গার্মেন্ট টিইউসি উত্তরা আঞ্চলিক কমিটির নেতা ও উত্তরার দক্ষিণখানে অবস্থিত ক্যাসিওপিয়া গার্মেন্টস লি. কারখানা কমিটির সভাপতি মাসুদ রানা, গার্মেন্ট টিইউসি নিপা ফ্যাশন ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লি. কারখানা কমিটির নেতা সাজু, লিটন, মাসুদ, সুমন, আবুল এবং মো. মাসুদ। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের দপ্তর সম্পাদক এবং উত্তরা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি জয়নাল আবেদীনকে গত ১৪ জানুয়ারি গভীর রাতে বোনের বাসা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছিল, আটকের ৩৬ ঘণ্টা পরে তাকে বিমানবন্দর থানায় গ্রেফতার দেখানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রিমান্ড আবেদন নাকচ করে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে। গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাভার উপজেলা কমিটির সভাপতি কবির খান মনিরকে। গত ৮ জানুয়ারি গার্মেন্ট টিইউসির সহ-সভাপতি এবং গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতি জনপ্রিয় শ্রমিকনেতা জিয়াউল কবির খোকনকে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়। শ্রমিকদের চাপের মুখে পরদিন সন্ধ্যায় তিনি মুক্তি পান।
শ্রমিকদের আন্দলনের মুখে মজুরি পুনর্বিবেচনার জন্য ৯ জানুয়ারি একটি ত্রি-পক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটিতে গার্মেন্ট টিইউসির সভাপতি অ্যাড. মন্টু ঘোষকেও সদস্য রাখা হয়েছিল। এই কমিটির দু’টি সভায় শ্রমিক পক্ষ তাদের বক্তব্য, দাবি এবং যুক্তি তুলে ধরেন। ১৩ জানুয়ারি কমিটি ডেকে মালিক ও সরকার পক্ষের সমঝোতায় পুননির্ধারিত মজুরি হার অন্যদের পড়ে শুনানো হয়, এখানে যোগ বিয়োগের আর কোনো সুযোগ ছিল না। মূলত যে গ্রেডসমূহে সংকট সেই ৬,৫,৪,৩ নং গ্রেডে যথাক্রমে ১৫ টাকা, ২০ টাকা, ১০২ টাকা, ২৫৫ টাকা বৃদ্ধি করে মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জলি তালুকদার গণমাধ্যমে বলেন, ‘শ্রমিকদের যৌক্তিক আন্দোলনের মুখে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন, সময় নেয়া, গার্মেন্ট টিইউসির সভাপতি মন্টু ঘোষকে কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি করা ইত্যাদি দেখে মনে হচ্ছিল সরকার কিছুটা হলেও গার্মেন্ট শিল্পে মজুরি সংকট সমাধানের পথে হাঁটবে। কিন্তু অবশেষে সরকার ও মালিকপক্ষ আবারো একটি একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলো। শ্রমিকরা লাউ এর বদলে এবার কদু পেতে যাচ্ছে। সরকার মজুরি বৃদ্ধির নামে আবারো শ্রমিকদের সাথে প্রতারণার পুনরাবৃত্তি ঘটালো।’
১৪ জানুয়ারি মালিক সমিতির বর্তমান সভাপতি এবং প্রাক্তন সভাপতি, বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রীর কড়া হুমকি উপেক্ষা করে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ কর্মবিরতি অব্যাহত রাখে। কিন্তু সরকার এবং মালিকপক্ষ যেহেতু মজুরি বৃদ্ধির পরিবর্তে চরম নির্যাতনের পথে আন্দোলন দমনের পথ গ্রহণ করেছে তাই তাদের সকল জুলুম-কৌশল এরইমধ্যে কার্যকর হয়ে যায়। হাজার হাজার শ্রমিকের নাম ও ছবি যার যার কারখানা গেটে টানানো হয়, নানান অভিযোগে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানানো হয়। যাদের নাম ছবি টানানো আছে তাঁরা গ্রেফতার এড়াতে কারখানা গেটে যেতে পারছেন না। অনেকেই স্থানীয় মাস্তান ও পুলিশের যন্ত্রণায় বাড়িতেও থাকতে পারছেন না, এলাকা ছাড়া। এই চাকুরিচ্যুত এবং গ্রেফতার আতঙ্কে থাকা শ্রমিকের মোট সংখ্যাটা কল্পনাও করা যায় না। এখন পর্যন্ত চার হাজারের কাছাকাছি। যাদের ছবি ওঠেনি, চাকুরি হারাননি তাদের সামনে দুটো পথই খোলা। হয় মাথা নিচু করে চুপচাপ কাজে যোগ দিতে হবে, অন্যথায় চাকুরি হারাতে হবে, এমনকি জেলেও যেতে হতে পারে। এই সাংঘাতিক ভীতি আর আতঙ্কের পরিবেশ দিয়ে মালিক-সরকার মজুরি বৃদ্ধির দাবি করা শ্রমিকদের ‘শায়েস্তা’ করতে সক্ষম হয়েছে বলেই আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
গত ৫ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের অবন্তি কালার নিটিং কারখানার শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকা গার্মেন্ট টিইউসি নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন জানান, এই কারখানায় হাজারখানেক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। মালিক ও সরকারের যৌথ দমন-পীড়নের কাছে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন কি পরাজিত হলো? এই প্রশ্নের জবাবে শ্রমিকনেতা ইকবাল বলেন, এই শোষণভিত্তিক সমাজে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের শেষ নাই। যত দিন শোষণ থাকবে ততদিনই মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের লড়তে হবে।
প্রথম পাতা
অভিবাসন খাতে দুষ্টচক্রের থাবা
ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন বোনাসসহ পর্যাপ্ত ছুটি দিতে হবে
প্রায় ৫৬ শতাংশের বেশি কোম্পানি কর দেন না
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে রুখে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিতে হবে
মালয়েশিয়ায় যারা সেকেন্ড হোম করে আছেন তারা বৈধভাবে অর্থ নেননি : বাংলাদেশ ব্যাংক
বর্ষবরণে ১৩ নির্দেশনা ও সময় বেঁধে দিল সরকার
ঈদযাত্রায় ভোগান্তির শেষ নেই ঘরমুখো মানুষের
বেতন-ভাতা ও বোনাসের দাবিতে জি-স্কপের সমাবেশ
মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা চর্চার মধ্য দিয়ে গোলাম আরিফ টিপুকে স্মরণ করা হবে
নোটিশ
Login to comment..