আগত যুদ্ধই যেন হয় শেষ যুদ্ধ
হিমাংশুদেব বর্মণ
পরাজিত শক্তির উত্থান কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। প্রশ্ন আসতে পারে হঠাৎ কেন এ কথা বলছি। না, হঠাৎ বলিনি আমি এ কথা। দেশের চলমান পরিস্থিতি বলছে যা, আমিও তা-ই বলছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার উপদেষ্টামণ্ডলী দিয়ে যা খুশি তা-ই করাচ্ছেন। নিজেও করছেন। ধানাই-পানাই কাজের সাথে ছক্কা-পাঞ্জা কথাও বলছেন যথেষ্ট। ক্ষমতায় বসেই নিজের নামে ঝুলে থাকা মামলা থেকে ছাড় নিয়ে নিলেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ভ্যাট আটশো কোটি টাকা মওকুফ করিয়ে নিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে থেকেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করালেন উপদেষ্টাদের দিয়ে। ভবিষ্যতে যার কর্ণধার উনি নিজেই হবেন। এখন কথা হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করা ও সেই দলের হয়ে প্রচার প্রপাগাণ্ডা করার কোনো বৈধতা আছে কি? এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তারা নির্দ্বিধায়। যে একঘেয়েমী আর স্বৈরাচারী আচরণের কারণে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে সেই একই কাজ করছে তার সরকার। সংস্কারের নামে সময় কাটাচ্ছেন নির্বাচনের। দেশে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মব সৃষ্টি করে ডাকাতি হরদমে চলছে। সবচেয়ে ন্যাক্বারজনক বিষয় হচ্ছে, ধর্ষকের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে, বিচার দাবি করছে তাদের প্রকাশ্যে খুন করার হুমকি দেয়া হচ্ছে, এ ব্যাপারেও সরকার বিস্ময়করভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে। মনে হচ্ছে এসব ব্যাপারে সরকারের কোনো দায়ই নেই। মূলতঃ এসব কারণেই মানুষের মন বিগড়ে যাচ্ছে। তারা মনে করছেন আগের দিনগুলোই বরং ভালো ছিল। এভাবে আবার তারা আওয়ামী লীগকেই প্রয়োজন মনে করতে পারে।
যে কারণে আমরা সবসময়ই ’৭১-এর পরাজিত শক্তির উত্থান দেখতে চাই না। এজন্য আমরা তাদের কর্মকাণ্ডকেও সমর্থন করি না। দেশ স্বাধীনের পরবর্তী সময়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলই না। তারপর বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থে সেই পরাজিত শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে রাজনীতির মাঠে নামতে উৎসাহ দিয়েছে এবং সহযোগিতাও করেছে। এমনকি বিএনপি তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারও গঠন করেছে। আর আওয়ামী লীগ তাদের নিয়ে সরকার গঠন করেনি। তবে তাদের আঁচলের তলে রেখে গালে চামচ চামচ মধু তুলে দিয়েছে। সেই মধুতে মেতে গিয়ে আঁচলের তল থেকে বেরিয়ে এসে আরো কিছু স্বাদ নিতে শুরু করে দিল নতুন খেলা।
গত বছরের ৫ আগস্টে তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনটি ছিল সময়ের দাবি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে একেবারে পাপের ষোলকলা পূর্ণ করে ফেলেছিল দলটি। আর তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হলো এমনই পরিণতি মেনে নিয়ে যে, দেশ স্বাধীনের নেতৃত্ব দেয়া দলটিই দেশবিরোধী আখ্যা পেয়ে গেল। এখন দেশের মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। যারা একটি কথা বলার সাহস করেনি। তারা আজ আঙুল তুলে বলছে- ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাংলাদেশে চলবে না।’ আজ শুধু তারাই নয়, দেশের জন্য যারা ভালো চায়, দেশের কল্যাণ কামনায় যারা রাজনীতি করে, দেশের ভালেরামন্দ নিয়ে যারা ভাবে, তারা সবাই বলছে আওয়ামী লীগ যেন এই মুহূর্তে ফিরে না আসে।
এর কারণ হিসেবে আমরা যা পাই, তা হলো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠার পেছনে একটি বড় যুক্তি তো অবশ্যই ছিল। আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ অপশাসনের কালে গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। একেবারে দলের তৃণমূল পর্যন্ত নেতারা হয়ে উঠেছিল বড় বড় খাদক। ছোট ছোট আমলারা হয়ে গিয়েছিল বড় বড় গামলা। খেতে খেতে খাদকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল তলা পর্যন্ত। তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় সাধারণ মানুষ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল সর্বস্তরের মানুষকে। সর্বোপরি দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে জাতীয় অর্থনীতিকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলে দিয়েছে। উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে সীমাহীন। বাক স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছিল গণমাধ্যমের। প্রগতিশীল রাজনীতিকে একদম খেয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তাদের সেই রাহুগ্রাস থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করেছে কেবল সিপিবসহ হাতে গোণা দুই চারটি বাম দল।
দেশ স্বাধীনের আগে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল দেশের মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই চুপসে গেল মানুষের সেই স্বপ্ন পুরনের আশা। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেই শুরু হয়ে গেল উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। ’৭৩ সারের ১০ মার্চ-এ রমনার কালিমন্দির ভাঙার মধ্য দিয়ে কবর রচনা করা হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার। ’৭৫-এ শেখ মুজিবের হত্যার পর দুই দুইটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হলো ক্যান্টনমেন্টে। তারা গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখালো দেশকে। জনগণের মতের তোয়াক্কা না করে গঠিত দলটি দেখালো গণতন্ত্রের স্বপ্ন। তখনও মানুষের আশা পূরণ হলো না। অবশেষে মানুষ ভেবেছিল শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা তাদের স্বপ্ন পূরণ করবেন। শেখ হাসিনা সেই জায়গাতেও দেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করলেন। স্বাধীনতার সুখ পেতে চেয়েছিল যে মানুষগুলো তারা তা পেল না কোনোদিন। সুখ পেয়ে গেল সেই মধুপায়ীরা। সেই আঁচলধারী আর আঁচলের তলাবাসীরা।
আজ দেশের মানুষ প্রমাদ গুনছে ওদের সবাইকে নিয়েই। যারা আঁচলের তলে বসে মধু খায় তাদের স্বরূপ তো কারো অজানা নয়। তাছাড়া আঁচলধারী তথা আওয়ামী লীগ এখন আহত বাঘ। রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারলে দেশের কাজে ওদের মন থাকবে না এতটুকু। আঘাতের জবাবে আঘাত হানবে কেবলই। মরণ কামড় দিবে যেখানে সেখানে। দেশের মানুষ গোল্লায় যাকগে, শেখ হাসিনা আগে দেখবেন কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের নাম মুছে গেছে। ওই নামগুলো আবার লেখার জন্য দশ টাকার জায়গায় দশ হাজার টাকা বরাদ্দ হবে। যারা মুছে দিয়েছে তাদেরকে টাইট দিতে হবে। এসব নিয়ে মেতে থাকবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। প্রতিশোধের নেশায় মাতিয়ে রাখা হবে তাদের রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলো। দেশের শান্তি এভাবেই বিনষ্ট হবে। তাছাড়া এরপর আর তাদের কূকর্মের প্রতিবাদ করারও কোন সুযোগ থাকবে না। সেই পুরনো দম্ভে তারা সব প্রতিবাদ ভশ্ম করে দিবে। বলবে আমরা তো ছেড়ে দিয়েছিলামই। তোমরা তো পারোনি দেশ চালাতে। সেই আমাদেরই আসতে হলো। আর আসতেই যখন হলো, তখন আমরা যেটা করি, তোমরা নীরবে তা মেনে নাও, নিতেই হবে। নইলে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ডাণ্ডা খেয়ে ঠান্ডা হয়ে যাবে। তারপর তাদের পুলিশ বাহিনী তো আছেই।
এছাড়া আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে নামতেই প্রতিপক্ষের শক্তিও মাঠে নেমে যাবে তাদের প্রতিহত করতে। আওয়ামী লীগও আহত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। কেবল তাদের ওপরই নয়, এতকাল যাবৎ যে বামদলগুলো তাদের বিরোধিতা করে আসছে তাদের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়বে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো। তখন বামদলগুলোর করণীয় কী থাকবে তা নিয়ে বিশদ ভাবনা ও আলোচনার মোক্ষম সময় এখনই।
আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হওয়ার আগে অনেক কিছু ভেবে দেখার আছে। তাছাড়া তাদের দুর্নীতিকে প্রতিহত করার সাহস এবং শক্তি অর্জন করতে হবে। ত্রিমুখী সংঘর্ষ গণতান্ত্রিক ধারায় মোকাবিলা করার মতো শক্তিশালী পল্টন তৈরি করতে হবে। আগত যুদ্ধই যেন শেষ যুদ্ধ হয়। দেশের মানুষকে আবার যেন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে না হয় স্বাধীনতার স্বাদ পেতে।
লেখক : সাংবাদিক
Login to comment..