করিডোর, বন্দর, আইএমএফের ঋণ এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন
দেড় দশকের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে আওয়ামী লীগকে একরকম টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে এদেশের মানুষ। বিনা ভোটে, রাতের ভোটে কিংবা নাটকের ভোটে ক্ষমতা দখলে রেখে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতাকর্মীরা যে শুধু দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার এবং ভিন্ন মত দমনে গুম-খুনের মতো অপরাধ করে গেছে তা নয়, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকেও বিপন্ন করেছে। একদিকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’র নির্দেশনা মতো দেশের বাজারকে তারা বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। মুদ্রাবাজার, পুঁজিবাজার, ব্যাংক ব্যবস্থাসহ সব ক্ষেত্রে বাজারি ব্যবস্থা চালু করে দেশের শিল্প-বাণিজ্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের চরম সঙ্কটের মুখে ফেলা হয়েছে। এসব কিছুর প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগ সরকার বার বার তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দরসহ দেশের বিভিন্ন সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাম, প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক মানুষের প্রতিরোধে তারা অনেকক্ষেত্রে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পশ্চিমাদের খুশি রাখতে শেষ দিকে তারা দেশের খনিজ সম্পদসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা বিদেশিদের ইজারা দেওয়ার আয়োজন করছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ায় সেই কাজগুলো সম্পন্ন করে যেতে পারেনি।
গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর অনেক কিছুর সঙ্গে মানুষের এটাও প্রত্যাশা ছিল যে, সব রকম বিদেশি শক্তির আধিপত্য ছুড়ে ফেলে দেশীয় বাস্তবতা ও জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হবে। কিন্তু ৯ মাস না যেতেই মানুষের সেই আশার গুড়ে বালি পড়তে শুরু করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে–যা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই পরনির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তুলবে না, সার্বিকভাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
প্রথমত, সরকার ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার কথা বলেছে। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করে রাখাইন রাজ্যে যাতায়াত করা যাবে। এর মূল উদ্দেশ্য বলা হচ্ছে, রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর সুবিধা দেওয়া। কিন্তু এই করিডোর দেওয়া হলে বাংলাদেশের সীমান্ত অরক্ষিত হয়ে পড়বে। কারণ, রাখাইন রাজ্য এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধার জন্য এই করিডোর ব্যবহার করতে পারে। আর সেটা হলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে দেওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার আগ্রহ। ১৪ মে বন্দর পরিদর্শনে বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম গিয়ে বলেছেন, “আর কিছু শুনতে চাই না, বন্দর ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর সেরা যারা তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ রাজি না থাকলে রাজি করাতে হবে।’
জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনযোগ না দিয়ে দেশের গুরুত্ব¡পূর্ণ বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এমন উৎসাহ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে দেশের স্বার্থবিরোধী। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সর্বশেষ ঋণের কিস্তি পাওয়ার জন্য সরকার সম্প্রতি আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। এর অর্থ হলো তাদের দেওয়া শর্ত মেনে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার উন্মুক্ত করা হবে, মুদ্রানীতি আরো সঙ্কোচন করা হবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ছাড় কমিয়ে আনা হবে এবং গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরো বাড়ানো হবে।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণের এই চুক্তিটি করে গেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। সংস্থাটি যেসব শর্ত পরিপালনের জন্য চাপ দিচ্ছে, সেগুলোও আওয়ামী লীগের আমলে করা চুক্তির আওতাধীন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর ড. ইউনূসের সরকার এসে ফ্যাসিস্ট আমলের অনেক আইন-কানুন, বিধি-বিধান, সিদ্ধান্ত-উদ্যোগ বাতিল করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আইএমএফের সঙ্গে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী চুক্তির ক্ষেত্রে এই সরকারও শেখ হাসিনার পথেই হাঁটছে।
সম্পাদকীয়
অমানবিক, অসভ্য, নজিরবিহীন ও বেআইনি
Login to comment..