করিডোর নয়, মানুষ চায় দ্রুত নির্বাচন
মোহাম্মদ শাহ আলম
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৯ মাস পার হয়ে গেল। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। খুন-খারাপি, মব সন্ত্রাস অব্যাহত আছে। বেশকিছু শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে গ্যাসের সংকটের কারণে, চালু শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শ্রমিকরা কাজ করেও তাদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পাচ্ছে না। শ্রমিকদের ওপর ছাঁটাই নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগকারীরা, বিনিয়োগ করতে আস্থা ও ভরসা পাচ্ছে না। ৩০ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। বড়লোকের সংখ্যাও বেড়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক ছিল, এখন আরো নাজুক হয়েছে। বর্তমানে উত্তপ্ত। সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক চলছে। ক্ষমতার নানা কেন্দ্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব, টানাপোড়ন, উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে শোনা যায়। ফলে দেশি-বিদেশি নানা শক্তি ও অপশক্তির তৎপরতা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে শঙ্কা ও অস্বস্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সরকারের আশু কাজ হলো- নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এর চেয়ে সরকারের তৎপরতা ও মনোযোগ বিদেশিদের সাথে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিপরীতে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তি করার দিকে নিয়োজিত। যা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ বলে জনগণ মনে করছে না। ফলে গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস বেড়েছে। তারা মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই-আগস্টের জনআকাঙ্ক্ষা ও শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পথে হাঁটছে।
গত কয়েক সপ্তাহে সংঘটিত কিছু ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। এর মধ্যে গত এপ্রিলের শেষ দিকে রাজনীতিতে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইনে খাদ্য সহায়তা পাঠানোর জন্য ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনা- মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত। সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টার এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের পর বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। পরে সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, কে কি বললো তাকে আমরা হিসাবে নিতে চাই না, আমাদের সীমান্তে পাশে যারা দখলে আছে তাদের সাথে আমরা সর্ম্পক করবো। এই বক্তব্য খুবই উদ্বেগজনক। নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশ মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে আসছে বছরের পর বছর। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি একটি জটিল ও আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা বাংলাদেশের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়।
‘মানবিক করিডোর’ মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে পাশ কাটিয়ে চালু করলে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, কারণ তারা এখনো ক্ষমতায়। তাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ ও দেশের জনগণ মনে করে। কিন্তু মানুষ সমস্যার সমাধান হোক তা চায়। জাতিসংঘের মানবিক করিডোর চালু করার বাংলাদেশের সীমান্ত ছাড়া অন্য পথও রয়েছে। সে সুযোগ ও পথ ব্যবহার করা উচিত বলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল মনে করে। এখানে চীন ভারতের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। রয়েছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। যা সরাসরি তাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। তাই সমস্যা সমাধানের প্রকৃত উপায় হলো চীন-ভারত-আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকারের সম্মনিতে করিডোর চালু করার উদ্যোগ নেওয়া। এখানে চীন ও ভারতের উদ্যোগ ও ভূমিকা হবে প্রধান। জান্তা ও আরাকান আর্মিকে যার যার স্বার্থ রক্ষা করে সমঝোতায় বসাতে পারে চীন ও ভারত। আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফেক ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আমাদের দেশের কাঁধের উপর মানবিক করিডোর হলে আমাদের দেশ, রোহিঙ্গা, আরাকান এলাকায় ও ভারতের একটি অংশ অগ্নিগর্ভ যুদ্ধ অবস্থায় পড়বে এবং পুরো অঞ্চল জুড়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ফলে রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মি কারো আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে না। তারা গিনিপিগে পরিণত হবে।
নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়ার জন্য সরকার চুক্তি করেছে। যে কোম্পানির সাথে আমেরিকার সর্ম্পক রয়েছে বলে জানা যায়। নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে হয়েছে। তিন হাজার কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। যা চালু ছিল বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। তা হঠাৎ করে বিদেশি ব্যবস্থাপনায় দিতে হবে কেন। এই প্রশ্ন রাজনৈতিক সচেতন-মহল, বন্দর ব্যবহারকারী ও জনগণের মধ্যে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে- এ কাজ তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ নয়। কি উদ্দেশ্যে তারা এই উদ্যোগ নিয়েছে, এখানে কি তাদের স্বার্থ। কেউ কেউ মনে করছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে নিজস্ব ও বিদেশি ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। এই বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রয়োজন বলে রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে।
নারী কমিশনের রির্পোট নিয়েও দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি। এটা নিয়েও দেশে বিতর্ক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। কমিশনের রির্পোট নিয়ে বিতর্ক ও ভিন্নমত থাকতে পারে এবং তা তারা করতে পারে। কিন্তু নারীদের বিরুদ্ধে মধ্যযুগীয় মৌলবাদী চেতনা ধারণকারী শক্তির অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দেশের সচেতন মানুষকে মর্মাহত করেছে। নারীরা নিজেদেরকে বিপন্ন মনে করছে। নারীদের ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে আক্রমণ হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সরকারের কোনো আইনি জোরালো পদক্ষেপ নেই।
এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি করে আসছিল বেশ কিছুদিন ধরে কিন্তু একশন প্রোগ্রাম নিয়ে রাস্তায় নামেনি। হঠাৎ করে একশন প্রোগ্রামের নামে প্রধান উপদেষ্টার অফিস-কাম-বাসভবন ঘেরাও করার কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেখানে কর্মসূচি ঘোষণাকারী ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং কর্মসূচির ধরণ দেখে এটাকে মানুষের কাছে পাতানো খেলা হিসাবে মনে হয়েছে। জুলাই-আগস্টের গুম, খুন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পতিত স্বৈরাচারের যারা জড়িত তাদের বিচার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। কিন্তু নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এবং সাথে সাথে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধন স্থগিত এটা নিয়ে জনগণ ও রাজনৈতিক মহলে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ বলছে এই পদ্ধতিতে এই কাজ আগেই করা যেত, কিন্তু এই সময়ে কেন?
যমুনার সামনে থেকে ফিরে জামায়াত, এনসিপি, হেফাজতসহ বিভিন্ন সংগঠন শাহবাগ অবরোধ করে। দাবি মেনে নেওয়ার পর সেই অবরোধ সমাবেশে উপস্থিত জনতা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার চেষ্টা করলে একটি স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী বাধা প্রদান করে এবং ‘গোলাম আজমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ বলে স্লোগান দেন। জাতীয় সঙ্গীতে বাধা দেওয়ার মতো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ যারা করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ সরকারের নেই। সরকার এখানে অসহায় না নির্লিপ্ততার কৌশল নিয়েছে তা জনগণের কাছে পরিষ্কার ও বোধগম্য নয়। প্রধান উপদেষ্টা তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের কথা অহরহ বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশে মেধাবী তরুণ নয়, নৈরাজ্যবাদী তরুণের জন্ম হয়েছে যা মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। যারা মানুষকে হুমকি দিচ্ছে, আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সরকার এটাকে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজে লাগাচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশী আক্রমণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই ধরনের কর্মসূচিতে একদিকে পাহাড়া আর সুরক্ষা দেওয়া যা যমুনাতে মানুষ দেখেছে। অন্যদিকে জবি ছাত্র-শিক্ষকদের কর্মসূচিতে আক্রমণ সরকারের এই দ্বিচারিতা সরকারকে বিতর্কিত করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরনের ভূমিকা মানুষ বারবার দেখছে। সরকার যে নিরপেক্ষ নয় তা দিনদিন পরিষ্কার হয়ে উঠছে। সরকারের মাথায় নির্বাচন নয়, বিশেষ বিশেষ দেশি-বিদেশি এজেন্ডা নিয়ে সরকার যে ব্যস্ত তা জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। এই পরিস্থিতিতে শাসন ক্ষমতার ভিতরে বাহিরে নানা জট-জটিলতা দ্বন্দ্ব-সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জন্য দায়ী কে? জনগণ বলছে- সরকারের নির্বাচন নিয়ে অপকৌশল এই জট-জটিলতা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অব্যাহত রাখার জন্য দায়ী।
আইনের শাসন, সামাজিক রাজনৈতিক স্থিতি এবং অর্থনীতিতে উৎপাদন বিনিয়োগ চালু ও আনতে হলে একটি নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নাই। তাই সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাড় না করিয়ে অবিলম্বে একটি অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা জরুরি। যা দেশে আইনের শাসন শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে, জাতিকে শঙ্কামুক্ত করতে পারো।
প্রথম পাতা
‘চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে স্বার্থবাদী শক্তির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে’
কমরেড শাহাবুদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে শোক
নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অসত্য দুরভিসন্ধিমূলক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত
নোটিশ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও চব্বিশের আকাঙ্ক্ষা থেকে দেশ দূরে সরে যাচ্ছে
‘যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনার ওপর এক নির্মম আঘাত’
প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন
গণতন্ত্র কায়েমে বৃহত্তর ঐক্যের লড়াই অনিবার্য
যুদ্ধাপরাধী আজহারুলের ‘বেকসুর’ খালাস
শ্রমিক-কর্মচারীদের সকল পাওনাদি ঈদের আগেই পরিশোধের দাবি
হাতিয়ার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তলিয়ে গেছে নিঝুমদ্বীপ
চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে হামলার নিন্দা
Login to comment..