মব, মোবাইল-আগামীর প্রশ্ন

মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
আসলে যারা মবের সঙ্গে জড়িত, মবকে উস্কে দেয়, মজা নেয়- পুরোটাই অন্ধ অনুসরণ, আর হুজুগের অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের খেলা। মব চলাকালে কে বা কারা, কেন- এ ধরনের প্রশ্ন করার সুযোগটাও থাকে না। একবার একজন শুধু বললো—ব্যস, অমনি শুরু। কারো হিতাহিত জ্ঞান এখানে কাজ করে না। একবিংশ শতাব্দির প্রজন্ম চিন্তাচেতনার বিকাশের পথ বাদ দিয়ে ঝগড়া, মারপিট, খুন, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, অন্যায় বলপ্রয়োগ, লুটপাট, হত্যায় মেতে উঠেছে এই মবের কাঁধে ভর করে। কিশোর, যুবক সম্প্রদায়ের কেউ এই অনাকাক্সিক্ষত স্খলন থেকে মুক্ত নয়। আমাদের সমাজ বাস্তবতাও এমনই। একটা সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দুঃশাসন, পাকিস্তানের সামরিক, কায়েমি স্বার্থবাদী শাসন তাড়ানোর জন্য মানুষ লড়েছে। আন্দোলন করেছে। মিছিল, মিটিং, স্লোগান, পোস্টার, দেয়াল লিখন, ছবি তৈরি, কার্টুন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি মাধ্যমে প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত অধিকারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ছিল। পিকেটিং, হরতাল, ধর্মঘটগুলোতে আপামর জনসাধারণের স্বার্থে সভা, সমাবেশ ছিল স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ গড়ার পেছনের অনুশীলন তথা নিত্যকার চিত্র। এগুলোর বিপক্ষে শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক দমন-পীড়নের ঘটনা সবারই জানা। একটা জাতিসত্তা হিসেবে সংস্কৃতি, আত্মপরিচয়ে, স্বাধীন একটা উৎপাদনশীল দেশ, অর্থনীতি, সব মিলিয়ে স্বাধীন, শোষণহীন বাংলাদেশ কায়েমের ইচ্ছেটাকে রুখে দিতেই শাসকগোষ্ঠী এই সংগ্রামে ত্রিশ লাখ বাঙালির প্রাণ নিয়েছে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়েছে। আর তখনই এদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ শাসকগোষ্ঠীর পূর্ণ সহযোগিতা নিয়ে হত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং মবে অংশ নিয়েছে। তাদের একটা ধর্মীয় আফিম খাইয়ে নামানো হয়েছিল যেখানে তাদের অংশগ্রহণ ছিল বিশ্ববিদিত। আজো সেই ধারা বজায় রয়েছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বৈরশাসকের অপশাসনের বিরুদ্ধে একটি ন্যায়সংগত লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশের মানুষ জিতেছে। ততদিনে দেশের দল, মতের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে দলীয়, উপদলীয় কোন্দল, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন, নানা পর্যায়ের সুযোগ-সুবিধার ভোগের নিমিত্তে লড়াই সংগ্রামের ভাষায়, সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসে। সড়ক-রেলপথ অবরোধ, হরতালের মতো তীব্র ভাষাগুলো পরিহার করতে থাকে। মানববন্ধন, অবস্থান, প্রতীকী ধর্মঘট নিয়েই এখন মানুষকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে গণসংযোগ, পিকেটিং, গণজমায়েত করতে অনেক টাকা পয়সা ঢালতে হয়। উপযোগ না থাকলে দলের কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ফলে এসব এখন তথাকথিত হয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাভের পেছনে কোটি টাকার অনুদানের প্রশ্নটি জড়িয়ে গেছে। বিনিয়োগের মতো এখানে রাজনৈতিক বাণিজ্য চলে। ফলে শাসকগোষ্ঠীও নিজস্ব আত্মরক্ষার কৌশলগত জায়গাতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী, দলীয় ক্যাডারদের সশস্ত্র বাহিনী কাজে লাগায়। কিছু সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনও তার নিজস্ব ছাত্র সংগঠন দিয়ে অনবরত সেই আত্মরক্ষার কাজটি চালাচ্ছে। জনসম্পৃক্ত করার কর্মসূচি নেই। সেই তুলনায় বাম সংগঠনের মধ্যে এধরনের চর্চা কম। যদিও বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস, কিংবা স্বৈরশাসক, সামরিক জান্তার শক্তির বিপরীতে নিজেদেরই টিকে থাকতে হলে উগ্র বলপ্রয়োগটা প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। সেজন্য সংগঠন শক্তিশালী হতে হয়। নিজেদেরকে তত্ব, তথ্যে সমৃদ্ধ হতে হয়, কৌশলী হতে হয়। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে,ব্যক্তিগত স্বার্থের জলাঞ্জলি দিতে হয়। মবের চর্চাটা আজকাল একটু বেশিই হচ্ছে। মোবাইল, ফেসবুক, লাইভ, ভিডিও ফুটেজে অতি উৎসাহী মহলের যুক্ত থাকার প্রবণতা, ভাইরাল হওয়া, ফলোয়ার বাড়ানোর প্রভাবও লক্ষণীয় হারে বেড়ে গেছে, তাই মব-র পরিসরও বেড়েছে। মানুষের জীবনবোধের গভীরতা কমে গিয়ে ভাসা ভাসা ধারণাকে প্রমোট করার প্রবণতা প্রবল বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। ভুয়া তথ্যের আদ্যোপান্ত না জেনেই এটাকে প্রমোট করার কতিপয় গোষ্ঠী সবসময়ই সক্রিয়। এরা সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকে। কতিপয় মিডিয়া স্রফে নিজস্ব ফলোয়ার বাড়ানো, বাণিজ্যিক প্রোডাক্টের প্রচার, বাজারজাত করার উদ্দেশ্যেই মবকে ব্যবহার করে। সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কাজ, অপপ্রচার, গুজব, হুজুগে মারপিট আগেও এগুলো হয়েছে। তখন মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুকের আগমন ঘটেনি। মব তখনও হয়েছে। গুজব রটেছে, গুজুগে মানুষ মেতেছে। প্রচার পায়নি। আমাদের ঔদার্য, সহনশীলতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, পরমতসহিষ্ণু মনোভাবের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে গেছে। তার ওপর আন্তর্জাতিক মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এই মবকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যায়। সাধারণ মানুষের জীবন, সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেলেও তাদের হুঁশ ফেরে না। নিজেকে বাণিজ্যসফল হিসেবে উপস্থাপন করার কৌশল হিসেবে এরা প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। এখানে রাষ্ট্রীয় আইন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যখন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন এটা উদ্বেগের। কেবলমাত্র নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা, কুক্ষিগত করা, রাজনৈতিক স্বার্থপরতার কারণেই এরা ব্যস্ত। ফলে মব-আক্রান্ত সাধারণ, দুর্বল, নিরীহ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। নিজেরাও জান বাঁচাতে পারতপক্ষে প্রতিরোধে যেতে দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে। আগে গ্রাম পর্যায়ে একজন চৌকিদার কেবল একটা লাঠি হাতে যে পরিমাণ সাহস নিয়ে একজন অপরাধী, চোর-ডাকাত কিংবা আসামি ধরার ক্ষেত্রে বিজ্ঞতার পরিচয় দিত, এখন আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও প্রশিক্ষিত নিরাপত্তা বাহিনীকে মব-আতঙ্কে ভুগতে হয়। ক্ষমতা আর ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে আমাদের মোহমুক্তি ঘটেনি। লেখক : সভাপতি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শ্যামগঞ্জ শাখা, ময়মনসিংহ

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..