তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস পুনঃপাঠ
আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন :
(গত সংখ্যার পর)
লড়াই শুরু
১৯৪৬ সালের মে মাসে খুলনা জেলার মৌভাগে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার অষ্টম সম্মেলনে “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ” বিষয়ক প্রস্তাবে ভাগচাষিদের শেষ সংগ্রামে প্রস্তুত হতে আহ্বান জানানো হয়। সম্মেলনে বর্গাদারদের জন্য তেভাগা আইন প্রণয়নের দাবি উত্থাপন করা হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় ৫ আগস্ট ‘শেষ সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হও’ শিরোণামে প্রস্তাব গৃহিত হয়। প্রস্তাবে শ্রমিক ও কৃষক অঞ্চলে সাহসী জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেয়া হয়। ২৯ জুলাই ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের আহ্বানে কলকাতা ও সন্নিহিত শিল্পাঞ্চলে ৬ লক্ষ শ্রমিক দিনব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালন করে। মুসলিম লীগ আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবস ঘোষণা করলে সমগ্র বাংলায় বিশেষ করে কলকাতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষ সংগ্রামে পরিণত হয় হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায়। চার দিনব্যাপি এ দাঙ্গায় শুধু কলকাতায় বহু মানুষ নিহত হয়। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে বিহার, নোয়াখালীতে। দাঙ্গা বিধস্ত কলকাতায় সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। কৃষকসভা তেভাগার ডাক দেয়।
নভেম্বরে আমন ধান কাটার সময় শুরু হয় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। তার আগে তিন মাস চলে পরিস্থিতি তৈরির কাজ। প্রখ্যাত কৃষক নেতা কমরেড বিনয় কোঙার লিখেছেন- “প্রাদেশিক কৃষকসভার পক্ষ হতে একটা প্রচার পুস্তিকা (ভাগচাষির সমস্যা ঃ ভাগচাষি ও গ্রামের অর্থনীতি) প্রকাশ করা হয়। তাতে বাংলার কৃষিব্যবস্থা, ভাগচাষিদের সমস্যা ও দুদর্শা, ভাগচাষিদের তেভাগা দাবির যৌক্তিকতা, সমাজের অগ্রগতি ও বৃহত্তর স্বার্থে ভাগচাষিদের দাবির সমর্থনে কেন মধ্যবিত্ত ও অন্যান্য অংশের মানুষের এগিয়ে আসা দরকার-সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল। এই প্রচার পুস্তিকার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভাগচাষির সমর্থনে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করা।” অবিভক্ত বাংলার ১৯টি জেলায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি ছিল তেভাগার প্রধান লড়াই কেন্দ্র। এছাড়া চব্বিশ পরগনা, মালদা, যশোর, খুলনা, বগুড়া, ঢাকা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পাবনা, মেদিনীপুর, নদিয়া, হুগলি, হাওড়া, বাঁকুড়া, বীরভূমে বিস্তৃত হয় তেভাগা আন্দোলন। ৬০ লক্ষ ভাগচাষি এতে অংশ নেয়। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে কৃষক সভার আওয়াজ: ১). আধি নাই, তেভাগা চাই ২). বিনা রসিদে ভাগ নাই ৩). পাঁচ সেরের বেশি সুদ নাই ৪). কর্জ ধানে সুদ নাই ৫). বাজে কোন আদায় নাই ৬). জমি থেকে উচ্ছেদ নাই ৭). জান দিব তবু ধান দিব না ৮). নিজ খোলানে ধান তোল ৯). ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
শুধু ভাগচাষি বা বর্গাদার কৃষক নয় তেভাগা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল ক্ষুদ্র কৃষক, যারা নিজস্ব জমির মালিক, আর ভূমিহীন ক্ষেতমজুর, ঐ দাবিতে যাদের কোন আশু স্বার্থ ছিল না। কিন্তু কেন তারা লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল তার কারণ নির্দেশ করতে কমরেড ভবানী সেন লিখেছেন- “সমগ্র কৃষক সমাজ এই আন্দোলনের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল কৃষি সমস্যার সমাধান। তারা অনুভব করতে পেরেছিল, যদি আন্দোলনটা জয়ী হতে পারে তাহলে জমিদারি ব্যবস্থার উপর আঘাত আসবে এবং জমির পুনর্বণ্টনের আশু সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যাবে।”
প্রখ্যাত কমিউনিস্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিক গোলাম কুদ্দুস লিখেছেন- “আর ক্ষেতমজুররা? তারা কেন দাঁড়িয়েছিল তেভাগা সংগ্রামের সামনের সারিতে? তাদের তো তেভাগার একভাগা পাওয়ারও সম্ভাবনা ছিল না। তাদের কী স্বার্থ? তারা কেন গুলি খেয়ে বিরাট সংখ্যায় শহীদ হল, জেলে গেল, তেভাগা সংগ্রামের সব ঝড়ঝাপটায় অটুট হয়ে টিকে রইল বর্গাদারদের পাশে? তারা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি এবং নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা দ্বারা বুঝেছিল তেভাগা সংগ্রামের সাথে তাদের ভাগ্য জড়িত। তাদের অনেকেই যুদ্ধকালের আগে ছিল বর্গাদার বা স্বল্পজমির মালিক। জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য এবং দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে পড়ে তারা জমিজামা, গবাদি পশু, ঘটিবাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে ক্ষীণ প্রাণটুকু বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু অনেকেই পারেনি, তারাই বেশির ভাগ মৃত্যুর শিকার হয়েছিল। এদের মধ্যে যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তারা সদ্য হাতছাড়া জমি ও হালের গরুর কথা ভুলতে পারেনি। ... তারা চোখের সামনে লক্ষ্য করেছিল, যে জোতদার-মহাজনের দখলে গেছে তাদের যথাসর্বস্ব, তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে তেভাগার সংগ্রাম। চেতন বা অবচেতন সত্তাতে তারা নাড়া খেয়েছিল, ভেবেছিল এই সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে জমির লড়াই ...।”
আন্দোলনের প্রসারের পর আন্দোলন কিভাবে পরিচালনা করতে হবে সে বিষয়ে ‘কৃষকের লড়াইয়ের কায়দা’ শীর্ষক নির্দেশাবলি সম্বলিত পুস্তিকা লিখেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি কমরেড কৃষ্ণবিনোদ রায়। বিনয় কোঙার লিখেন “তাতে দাবির চরিত্র কী হবে, আন্দোলন কিভাবে রক্ষা করতে হবে, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের কাজ কী হবে, সংগঠনের কাঠামো কী হবে, সে সম্পর্কে নির্দেশাবলি দেয়া ছিল। জান দিব তবু ধান দিব না, তাড়াতাড়ি ধান কাটো, নিজ খামারে ধান তোল, তেভাগার কমে আপোস নাই, সমিতির বাইরে কৃষক নাই, বাড়ি বাড়ি ভলান্টিয়ার চাই ইত্যাদি আওয়াজগুলি এই নির্দেশনামা থেকেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।”
চব্বিশ পরগনার সংগ্রামী কৃষক নেতা কমরেড হেমন্ত ঘোষাল লিখছেন- “গ্রামে গ্রামে প্রচারাভিযান সংগঠিত হল, বলা হল, তেভাগার লড়াইয়ে নামতে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে- পরিবারপিছু একজন যুবক, একটি টাকা ও একটি লাঠি দিতে হবে। অদ্ভুত সাড়া পাওয়া গেল- ২০ দিনের মধ্যে ১২০০ জওয়ান ছেলে, ১২০০ টাকা ও ১২০০ লাঠি সংগৃহীত হল।... পরিবারের শক্ত, সমর্থ পুরুষটিকে লড়াইয়ে পাঠিয়েই তারা ক্ষান্ত হল না, ঘাঁটি আগলানোর জন্য ২০ দিনের মধ্যেই ১৫০০ জনের সংগঠিত নারী প্রতিরোধবাহিনী গড়ে তুলল।” নড়াইলে দুর্ধর্ষ কৃষকনেত্রী সরলা সিং এর নেতৃত্বে তিনশ’ নারীর সংগ্রামী বাহিনী গড়ে উঠেছিল।
সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর তিন মাসের প্রস্তুতি পর ১৯৪৬ সালের নভেম্বরের শেষে পাকা ধান কাটার সময় এল। প্রস্তুতি অনুযায়ী কৃষক সভার ভলান্টিয়ার বাহিনীর প্রত্যক্ষ পাহারায় বর্গাদাররা ধান কেটে নিজেদের খোলানে তুলে নিল। জোতদারের কাছে নোটিশ পাঠিয়ে তার তিনভাগের একভাগ বুঝে নিতে বলা হল। জোতদাররা সাড়া না দেয়ায় গ্রামবাসীকে স্বাক্ষী রেখে তাদের ভাগ আলাদা করে রেখে দেয়া হলো। বর্গাদার পুলিশের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষটি ঘটে বর্তমান পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি উপজেলার রামপুর গ্রামে। এ ঘটনায় ছড়িয়ে পড়ে বর্গাদার বিদ্রোহ। রামপুর গ্রামে প্রখ্যাত কৃষক নেতা কমরেড সুশীল সেনের উপস্থিতিতে ভলান্টিয়াররা ফুলঝরি নামের বর্গাদারের জমিতে ধান কাটতে গেলে পুলিশ বাঁধা দেয়। পুলিশের আঘাতের বিরুদ্ধে গাইন হাতে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন একজন রাজবংশী তরুণী বিধবা দ্বীপশ^রী বর্মনী। অন্য কৃষক কর্মীরা তাকে অনুসরণ করে। দ্বীপশ^রীর গাইনের আঘাতে হাবিলদারের দাঁত ভেঙে যায়। পুলিশ হটে যেতে বাধ্য হয়। বর্গাদারদের এ বিজয় পুরো আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে দেয়। ঘটনার পনের দিনের মধ্যে তখনকার দিনাজপুর জেলার ত্রিশটি থানার বাইশ টিতে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। ড. সুনীল সেন লিখেছেন- “লাঠি নিয়ে চলাফেরা করাটা স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল; লাঠিয়াল বাহিনী এতকাল ছিল জমিদারদের পোষা চিরাচরিত ব্যাপার; এখন স্বেচ্ছাসেবকরা হলেন কৃষকসভার লাঠিয়াল।”
ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি লক্ষ লক্ষ বর্গাদার ফসল তোলেন নিজেদের খামারে। হাজার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হল। ১৩ ডিসেম্বর সারা ভারত কৃষকসভার সভাপতি কমরেড মুজফফর আহমেদ ও বঙ্গীয় কৃষকসভার সভাপতি কৃষ্ণবিনোদ রায় সহাস্রাধিক কৃষকসভা কর্মীকে গ্রেপ্তারের নিন্দা করে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। ১৯৪৭ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের চিরির বন্দরের তালপুকুর গ্রামে পুলিশ গুলি করে বর্গাদার সমিরুদ্দীনকে হত্যা করলে ক্ষেতমজুর সাঁওতাল শিবরাম মাঝির নিক্ষিপ্ত তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় হত্যাকারী পুলিশ। অন্য পুলিশরা গুলি করে তৎক্ষণাত হত্যা করে সাহসী কৃষক স্বেচ্ছাসেবক শিবরামকে। তেভাগা আন্দোলনের প্রথম শহীদ একজন বর্গদার, অন্যজন ক্ষেতমজুর।
৯ জানুয়ারি বর্তমান নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার কৃষককর্মী তন্নারায়ণকে সন্ধ্যাবেলায় অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে জোতদার মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বাহিনী। ২০ জানুয়ারি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহুকুমায় খাঁপুরে প্রতিরোধকারী কৃষকদের ওপর পুলিশ ১২১ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে তৎক্ষণাত এবং হসপাতালে মিলিয়ে মোট ২২ জন কৃষক মৃত্যুবরণ করে।
কৃষকদের অনমনীয় মনোভাব দেখে মুসলিম লীগ সরকার ১৯৪৭ সালে ২২ জানুয়ারি জনসাধারণের অবগতির জন্য ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’ ১৯৪৭ প্রকাশ করে। এই বিল বর্গাদার আন্দোলনে যেমন উৎসাহের সঞ্চার করে, তেমনই আন্দোলন সম্পর্কে একটা সহজ মনোভাবও গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কমরেড ভবানী সেন লিখেছেন- “এ থেকেই সূচিত হয় আন্দোলনের দ্বিতীয় স্তর। ... আন্দোলন তৎক্ষনাত দূরবিস্তৃত ও ব্যাপক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। ... আধিয়াররা এক-তৃতীয়াংশ ভাগ রাখতে দিয়ে জোতদারদের গাদা থেকে ধান উদ্ধার করতে লাগল। যেসব গ্রাম এতাবৎ আন্দোলনে প্রভাবিত হয়নি সেগুলো আন্দোলনের সারিতে এসে যুক্ত হল এবং তেভাগা বলবৎ করল।...হাজার হাজার গ্রাম পরিণত হলো রক্তপতাকার সংগঠিত দূর্গে। ...কৃষকসমাজের ঐক্য ও দৃঢ়তার প্রভাব পড়ল মন্ত্রিসভার উপর, মন্ত্রিসভা বন্ধ করল ‘অপ্রয়োজনীয়’ পুলিশি হস্তক্ষেপ। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ মনে হল আন্দোলন সাফল্যের শীর্ষদেশ পৌঁছেছে। এক অগণতান্ত্রিক অত্যাচারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার মহান সংগ্রাম জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছুলো।”
দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং পার্টির জেলা সম্পাদক কমরেড সুশীল সেন খসড়া বিল কৃষকদের মাঝে কী প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল সে সম্পর্কে লিখেছেন- “আগুনের মতো এ সংবাদ গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। সংগ্রাম এবার নতুন মোড় নিল। এক নতুন জঙ্গি অধ্যায়। এই অধ্যায় ‘খোলান ভাঙা’ আন্দোলন নামে পরিচিত।” যে ভাগচাষিরা ভয়ে জোতদারের খোলানে নিজের ধান তুলেছিল তারা সমিতির ভলান্টিয়ারদের সহযোগিতায় জোতদারের খোলান থেকে নিজেদের খোলানে ধান নিয়ে আসে।
মহাত্মা গান্ধী ৩০ জানুয়ারি ও পরে ১২ ফেব্রুয়ারি তেভাগার ন্যায্যতার পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি জোতদারদের পরামর্শ দেন তেভাগা মেনে নিতে। তিনি তেভাগার দাবি সাম্প্রদায়িক এ প্রচারণার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।
কৃষকদের অভ্যুত্থানে বিচলিত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ জোটবদ্ধ হয়। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকার গ্রামে গ্রামে কৃষকদের উপর স্টীম রোলার চালায়। ৪ জানুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল তিন মাসে দিনাজপুরে ৪০ জন, জলপাইগুড়িতে ১৫ জন, চব্বিশ পরগনায় ৭ জন, ময়মনসিংহে ৪ জন, রংপুরে ১ জন, হাওড়ায় ১ জন, খুলনায় ২ জনসহ মোট ৭৩ জন কৃষক শহীদ হন। খাঁপুর, ঠুমনিয়া, মালবাজার, মেটলি, ডিমলা, শোভনা, তমলুক, কাকদ্বীপ ও অন্যান্য এলাকার কৃষাণ ও কৃষাণীরা সশস্ত্র আক্রমণের মুখে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। হিন্দু ও মুসলিমরা হিংস্র অত্যাচারের সাধারণ শিকারে পরিণত হয়েছিল। কৃষক রমনীরা পুলিশ ও জোতদারের লাঠিয়ালদের ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। হাজার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছিল। গ্রামছাড়া হয়েছিল তারা। ফেব্রুয়াররি শেষ দিকে শহুরে মধ্যবিত্তের সহানুভুতির কারণে পুলিশি নির্যাতন কমে আসতে থাকে। আসন্ন দেশভাগ উপলক্ষে মানুষের দৃষ্টিও অন্যখাতে প্রবাহিত হতে থাকে। আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
খাঁপুরে গুলিতে আহত কৃষক বালুরঘাট হাসপাতালে মরার আগমুহূর্তে কী চান জিজ্ঞেসিত হয়ে বলেছিলেন- তেভাগা চাই। কিন্তু খসড়া বিল আইনে পরিণত না হওয়ায় লড়াইয়ে এ পর্বে বর্গাদারদের প্রাণের দাবি তেভাগা বাস্তবায়িত হয়নি।
দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান আমলে কমরেড ইলা মিত্র ও রমেন মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগার লড়াই পরিচালিত হয় বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এলাকাকে কেন্দ্র করে। কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের টংক এলাকায় টংক প্রথার বিরুদ্ধে পুনরায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। সিলেটের বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও সন্নিহিত এলকায় কমরেড অজয় ভট্টাচার্য, বারীন দত্তের নেতৃত্বে নানকার প্রথার বিরুদ্ধে পুনরায় আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশদের চেয়েও বেশি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে আন্দোলন দমন করতে। কমরেড ইলা মিত্রের প্রতি নিগ্রহ। কমরেড মণি সিংহের প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা পাকিস্তান রাষ্টের চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
পূর্ব বাংলায় জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ
১৯৪৮ সালে এপ্রিল মাসে প্রাদেশিক সরকার পূর্ব বাংলার বিধান পরিষদে ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’ পেশ করে। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’ নামে গৃহিত হয়। এভাবেই কৃষকদের দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
ভবানী সেন- বাঙলায় তেভাগা আন্দোলন
পশ্চিমবঙ্গ- তেভাগা সংখ্যা, বর্ষ ৩০, সংখ্যা ৪২-৪৬, ১৯৯৭
ধনঞ্জয় রায়- তেভাগা আন্দোলন
বদরুদ্দীন উমর- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক
মঞ্জু কুমার মজুমদার, ভানুদেব দত্ত- বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধান
লেখক : সদস্য, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটি
Login to comment..