বাজেট, বাজেটের শ্রেণিচরিত্র ও মক্তিযুদ্ধের অর্থনীতি

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

আগামী ১ জুন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ হবে। প্রতিবারের মতো এবারও তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ও প্রচার-প্রচারণার কোনো কমতি নেই। ভাব দেখানো হচ্ছে যেন এই বাজেটের ওপর জনগণের জীবনের ভালো-মন্দের সবটা নির্ভর করছে! কিন্তু তা কতোটা সত্য? একটি দেশের জাতীয় বাজেট হলো পরবর্তী অর্থবছরের জন্য রাষ্ট্রের (তথা সরকারের) আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পিত হিসাবের আনুষ্ঠানিক বিবরণী। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত সংসদই কেবল জাতীয় বাজেট প্রণয়নের (এবং সেই ভিত্তিতে তার বাস্তবায়নের) ক্ষমতা রাখে। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সেই বাজেট প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। অধিকাংশ সংসদ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে, কোনো সংশোধনী ব্যতিরেকেই, কিংবা প্রয়োজনমতো সংশোধন করে, অনুমোদন করা হয়। তারপর তা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য অনুসরণীয় আইনে পরিণত হয়। এই বাজেট অনুসরণ করে পরবর্তী অর্থবছরে সরকার কর, শুল্ক, লেভি ইত্যাদি সংগ্রহ করার এবং নির্দিষ্ট খাতগুলোতে খরচের জন্য অর্থ-বরাদ্দ করার আইনগত অধিকার লাভ করে। বাজেটে যদি আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে সেটিকে ঘাটতি বাজেট বলা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে ঘাটতি পূরণের জন্য আভ্যন্তরীণ ঋণ, বিদেশি ঋণ-সাহায্য ইত্যাদি গ্রহণসহ কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, সে পরিকল্পনাও বাজেটে উল্লেখ থাকে। আবার ঘাটতি বাজেটের বদলে কখনো কখনো উদ্বৃত্ত বাজেট (যেখানে আয়ের চেয়ে ব্যয় কম) প্রণীত হয়ে থাকে। বাজেটে যদি আয় ও ব্যয় সমান হয় তাহলে তাকে ব্যালেন্সড বাজেট বলা হয়। ঘাটতি, উদ্বৃত্ত বা ব্যালেন্সড– যে ধরনের বাজেটই প্রণীত হোক না কেন, তাতে মোট জমা ও মোট খরচের পরিমাণ সমান সমান হতে হয়। বাজেটে জমা-খরচের হিসাব মিলাতেই হবে। এদিক থেকে (অর্থাৎ টেকনিক্যাল দিক থেকে) বিবেচনা করলে বাজেট হলো ক্রেডিট ও ডেবিটের হিসাব মেলানোর একটি কসরত। অর্থাৎ একদিক থেকে বিবেচনা করলে এটি একটি ‘অ্যাকাউনটেন্সির’ কাজ। দেশের শাসকগোষ্ঠী ও সরকারের নজর থাকে এদিকেই। একই সাথে বাজেটের থাকে চরিত্র ও দর্শনগত ভিত্তি। আমাদের দেশে বছরের পর বছর ধরে ‘সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা-পুঁজিবাদের’ ব্যবস্থা বহাল আছে। এক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনার বদলে বাজেটের চরিত্র ও দর্শনের ক্ষেত্রে ‘যা চলছে তাই চালু রাখা’ হচ্ছে। সে কারণে বাজেটের পুরানো কাঠামো বদলানোর প্রয়োজন হয় না। পুরানো বাজেটের এখানে একটু পরিমাণ বাড়িয়ে, ওখানে একটু কমিয়ে, পুরানো কিছু বাদ দিয়ে, নতুন কিছু যোগ দিয়ে, জমা-খরচের হিসাব মিলিয়ে দিতে পারলেই বাজেট প্রণয়নের কাজ শেষ! নতুন বোতলে সামান্য স্বাদ বদল করা পুরানো মদ ঢেলে কথার চমক দেয়া আবরণে পরিবেশন করার মতো করে মূলতঃ দক্ষ আমলাদের হাতে গোটা কাজটি সম্পাদিত হয়। এ রকমই চলছে বছরের পর বছর ধরে। এভাবে একই গতানুগতিক ধারায় যে বাজেট অর্থবছরের শুরুতে প্রণীত হয় সেটিও ঠিক রাখা হয় না। বছর শেষে ‘সংশোধিত বাজেট’ হাজির করা হয়। নতুন অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের আগে ফেলে আসা বছরের সেই সংশোধিত বাজেট পাস করিয়ে নিতে হয়। প্রতিবারই এই দু’য়ের মধ্যে তারতম্য থাকে। তা যে থাকবে সে কথা জেনে-বুঝেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়। জনগণকে, অথবা কোনো বিশেষ মহলকে তুষ্ট করার জন্য অবাস্তব প্রস্তাব আড়াল করে লোক দেখানো ‘জনতুষ্টির বাজেট’ পেশ করার চাতুরিপূর্ণ কৌশল এবং বিভিন্ন স্বার্থ-গোষ্ঠীর লবিং-এর কাছে সরকারের নতি স্বীকার করার কারণেই এরকম হয়ে থাকে। এভাবে শুরুতেই বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করা হয়। তাছাড়া, মৌলিক প্রশ্ন হলো- দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে বাজেটে ভূমিকা আসলে কতোটা? এক্ষেত্রে, গোটা অর্থনীতির আয়তনের কতোটা পরিমাণ ‘বাজেট’ এবং কতোটা পরিমাণ ‘বাজেট-বহির্ভূত’ অংশ, প্রথমে সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেশের বাজেটের পরিমাণ জিডিপি’র এক-পঞ্চমাংশেরও কম। এই দৃশ্যমান জিডিপির সিংহভাগ (ধরে নিলাম তার ৭৫ শতাংশ) সম্পদ রয়েছে মুষ্টিমেয় লুটেরা বিত্তবানের হাতে। তাছাড়া, এর বাইরে রয়েছে অপ্রদর্শিত কালো টাকা, অর্থমন্ত্রীর অনুমান অনুসারে যার পরিমাণ জিডিপি’র প্রায় ৮০%। এই কালো টাকার প্রায় সবটাই রয়েছে লুটেরা ধনিকদের হাতে। তাহলে বলা যায় যে, দেশের অর্থনীতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কালো টাকার মালিক ও লুটেরা বিত্তবানদের হাতে। এই আর্থিক শক্তির তুলনায় এবারের ৭ লক্ষ কোটি টাকার ‘বিশাল’ বলে আখ্যায়িত বাজেটের পরিমাণ ১২%-১৩%-এর বেশি হবে না। এই হিসাব থেকেই বোঝা যায় যে দেশের গোটা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এখন চলে গেছে একচ্ছত্রভাবে কালো টাকার মালিক ও লুটেরা বিত্তবানদের হাতে। ফলে এমনিতেই জাতীয় বাজেটের পক্ষে অর্থনীতির হাল-চাল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা খুবই সীমিত। যেটুকু আছে সেটুকুও, রাষ্ট্রক্ষমতা লুটেরা বিত্তবানদের দখলে থাকায়, তাদের হাতেই কুক্ষিগত রয়েছে। কয়েক বছর আগে সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার পর তা নিয়ে কয়েকজন শিক্ষিত বন্ধুর সাথে তুমুল আলোচনা চলাকালে পাশে দাঁড়ানো একজন শ্রমজীবী মানুষ আমাদের ‘পাণ্ডিত্যপূর্ণ’ আলোচনা থামিয়ে দিয়ে বললেন- আপনারা লম্বা কথা থামান তো! কেমন বাজেট- তা আমার কাছে শুনুন। এ বাজেট হলো– উপরতলার বড়লোকদের জন্য ‘স্যাটেলাইট’, আর নিচের তলার খেটে খাওয়া গরিব মানুষের জন্য ‘হালুয়া টাইট’। এটিই বাস্তব যে আমাদের সমাজ হলো শ্রেণিবিভক্ত। সমাজে বিরাজ করছে শ্রেণিবৈষম্য ও ধনবৈষম্য। একদিকে রয়েছে ‘উপরতলার ১%’ (যারা সম্পদশালী), আর অন্যদিকে রয়েছে ‘নিচতলার ৯৯%’ (যারা সম্পদ বঞ্চিত)। কোনো বাজেটেরই ‘শ্রেণি নিরপেক্ষ’ অথবা ‘ধনী-দরিদ্র নিরপেক্ষ’ হওয়া সম্ভব নয়। সম্পদ হয় ‘উপর থেকে নিচের দিকে’ অথবা ‘নিচ থেকে উপর দিকে’ পুনর্বণ্টিত হতে পারে। বাজেটকেও তাই এই দু’এর মধ্যে একটি ধারায় সম্পদের পুনর্বণ্টিত হওয়ার প্রক্রিয়ার সহায়ক হতে হবে। এক্ষেত্রে ‘নিষ্ক্রিয় নিরপেক্ষতার’ কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু একমাত্র সম্পদের পুনর্বণ্টনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব হতে পারে তাই এই দু’য়ের মধ্যে কোনটি ঘটবে সমাজের মূল দ্বন্দ্ব তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তার ওপর নির্ভর করে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য ও ধনবৈষম্যের হ্রাস-বৃদ্ধি। সেটি আবার নির্ভর করে দেশের অর্থনেতিক-সামাজিক নীতি-ব্যবস্থার ওপর। ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশভাবে ১% লুটেরা গোষ্ঠীর হাতে থাকায় প্রচলিত আইনি ব্যবস্থায় সেখান থেকে ৯৯%-এর স্বপক্ষে সম্পদের পুনর্বণ্টন ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাজেটের ক্ষেত্রে ‘উপর থেকে নিচের দিকে’ সম্পদের পুনর্বণ্টনের আইনি সুযোগ আছে। তবে সেক্ষেত্রে দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকা এবং ৯৯% বঞ্চিত মানুষের জোরদার সংগ্রাম থাকা অপরিহার্য। কিন্তু দেশে আজ তা সেভাবে নেই। ফলে, লুটেরা শাসকরা বাজেটকে প্রধানত ১% লুটেরাদের স্বার্থে সম্পদের ‘নিচ থেকে উপর দিকে’ পুনর্বণ্টনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। অনেকে অবশ্য দাবি করে থাকেন যে বাজেট যদি ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ হয় তাহলে তাকে ‘শ্রেণি-নিরপেক্ষ’ বলা যেতে পারে। বাজেটকে তার ভালো-মন্দ ও সবলতা-দুর্বলতার দিকগুলোর হিসাব থেকে তার ভারসাম্যতা পরিমাপ করা যেতে পারে। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, অন্যান্য বিষয়ে ভারসাম্যের বিবেচনা প্রাসঙ্গিক হলেও হতে পারে, কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ‘উপর থেকে নিচে’ আর ‘নিচ থেকে উপরে’ সম্পদের পুনর্বণ্টনের প্রশ্নে ১% ও ৯৯%-এর মধ্যে যে মৌলিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সেক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বা ভারসাম্যের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। দরিদ্র মানুষদের জন্য বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নানা প্রজেক্টে নানা ধরনের ভাতা, অনুদানের জন্য অর্থ বরাদ্দের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন যে, বাজেটে ধনী-দরিদ্র উভয়ের স্বার্থে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। এক ভদ্রলোক হোটেলে গিয়ে খরগোশের মাংসের ডিশ অর্ডার দেয়ায় হোটেল ম্যানেজার তাকে জানালেন যে তারা আলাদাভাবে খরগোশের মাংস রান্না করেন না। তারা খরগোশ ও ঘোড়ার মাংস ‘ভারসাম্যপূর্ণভাবে’ সমানে-সমানে মিশিয়ে রান্না করে থাকেন। বাধ্য হয়ে সেই ‘মিক্সড ডিশ’ অর্ডার দিয়ে তা খাওয়ার পর ভদ্রলোক ম্যানেজারকে ডেকে এনে জানতে চাইলেন যে, খাওয়ার সময় তো খরগোশের মাংস সামান্যই মুখে পড়লো, সব তো মনে হলো ঘোড়ার মাংস। অথচ আপনি আমাকে মিথ্যা করে কেন বলেছিলেন যে, দুটোকে সমানে-সমানে মিশিয়ে রান্না করা হয়েছে? ম্যানেজার জবাবে বললেন, ‘স্যার! আমি আসলে সত্য কথাই বলেছি, ‘একটা ঘোড়ার’ সাথে ঠিক ‘একটা খরগোশের’ পুরোটা সমানে-সমানে মিশিয়েই এই ডিশ রান্না করা হয়েছে। ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর’ খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হলো কি না এবং কতো করা হলো তা প্রধান কোনো বিষয় হতে পারে না। মৌলিক বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও দরিদ্র-মধ্যবিত্ত জনগণকে ‘দরিদ্র ভাতার’ ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হবে কেন? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! এমন হবে– সেজন্য তো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি! নিজের ‘শ্রমের ফসলের’ ওপর মেহনতি মানুষের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। একাত্তরে যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছিল তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ছিল কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ। অথচ তাদের সৃষ্ট সম্পদের ওপর তাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের আজ ‘অনুদান-ভাতা-খয়রাতি’ ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থা ও ব্যবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন হলো- একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে তার বাৎসরিক আয়-ব্যয় সম্পর্কে আগাম পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা জাতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। এদেশে এবার বাৎসরিক বাজেট এমন একটি সংসদে পাশ হতে যাচ্ছে যার সদস্যরা প্রহসনমূলক ‘রাতের ভোটে’ নির্বাচিত ‘ঘোষিত’ হয়েছে। তাদের প্রতিনিধিত্বশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ। এমন সংসদের করারোপের নৈতিক অধিকার সম্পর্কে সংশয় রয়ে গেছে। এবার ৭ লক্ষ কোটি টাকার বিশাল বাজেট পেশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই বিশাল আকার অনেকটাই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। দেখতে বিশাল হলেও সেটি মুখে তোলার পর তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা এরকম হাওয়াই মিঠাই মার্কা বাজেটই পেতে চলেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ যে বাজেট দিয়েছিলেন তার পরিমাণ ছিল ৭০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। এবার তার তুলনায় ১০০০ গুণ বড় বাজেট পেশ করা হবে। এসময়ের মধ্যে টাকার মান কমে যাওয়ার হিসাবকে বিবেচনায় নিলেও এই বৃদ্ধির পরিমাণ হবে নিঃসন্দেহে কয়েকশগুণ। কিন্তু গত ৫০/৫১ বছরে দেশের ৯৯% গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার মান সেই পরিমাণের ধারেকাছেও বেড়েছে কি? বাজেটের পরিমাণ যে ১০০০ গুণ বাড়লো সেই অর্থ তাহলে কার পকেটে গেছে ও যাচ্ছে? তা যাচ্ছে ১% লুটেরা কোটিপতিদের পকেটে। এসময়ে তাদের কারো কারো সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে কয়েক লক্ষ গুণ। ফলে মুক্তিযুদ্ধে যে সাম্যের সমাজের অঙ্গীকার ছিল, সেদিকে অগ্রসর হওয়ার বদলে সমাজে বৈষম্য বেড়ে চলেছে রকেট গতিতে। বাজেটের অর্থনৈতিক-সামাজিক দর্শন হলো তার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। প্রশ্ন হলো– কী হওয়া উচিৎ বাজেটের দিক-দর্শন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা-মর্মবাণীর মাঝেই রয়েছে এ প্রশ্নের দ্ব্যর্থহীন স্পষ্ট জবাব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেবল কোনো বিমূর্ত বায়বীয় স্লোগান বা নিছক ভাবাবেগের বিষয় নয়। তার রয়েছে সুনির্দিষ্ট রূপ ও উপাদান। সংবিধানে এবং আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সংবিধানে ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তথা- ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার’ মাঝেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা-মর্মবাণীর মূর্ত প্রকাশ। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের পঞ্চদশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং ... নাগরিকদের জন্য... (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা। ” এখানে স্পষ্টতই ব্যক্তিমালিকানা-ব্যবস্থা নির্ভর খোলাবাজার অর্থনীতির পথ-নির্দেশ করা হয়নি। বলা হয়েছে ‘পরিকল্পিত অর্থনীতির’ কথা। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান- এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা এবং সক্ষম সব মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করাটা যে সমাজের, এবং সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব– এই দাবি বহু পুরানো।’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায়,’৬৯ এর ঐতিহাসিক ১১-দফাতে এই দাবি ও এর সাথে ব্যাংক বিমা বৃহৎশিল্প জাতীয়করণ, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পরিকল্পিত অর্থনীতি, সমবায়, ভূমিসংস্কার ইত্যাদি দাবিগুলোও ক্রমান্বয়ে যুক্ত হয়েছে।’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যসহ এসব কর্মসূচির কথা ছিল। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যে কর্মসূচি, নীতি ও লক্ষ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, যে কোনো অজুহাতে তা থেকে সরে আসার চেষ্টা একটি দুরভিসন্ধিমূলক ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক ষড়যন্ত্র বৈ অন্য কিছু নয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- “যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে... প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল– জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে। ” প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে “রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে... এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা– যেখানে ... রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। ” রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে ১০ম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে। ” ১৩তম অনুচ্ছেদে মালিকানা সম্পর্কে বলা হয়েছে, “উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা-ব্যবস্থা নিম্নরূপ হইবে: (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা; (খ) সমবায়ী মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায়সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা এবং (গ) ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা। ” লক্ষ্যণীয় যে, সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে প্রাধান্য দিয়ে সমবায়ী ও ব্যক্তি মালিকানাকে আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধকৃত অবশিষ্টাংশ সম্পদ (ৎবংরফঁধষ)- হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সংবিধান থেকে এ ধরনের আরো উদ্ধৃতি দিয়ে স্পষ্টভাবে দেখানো যায় যে পরিকল্পিত অর্থনীতি, অর্থনীতির প্রধান প্রধান ক্ষেত্রগুলোর রাষ্ট্রীয় মালিকানা, নাগরিকদের জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, মেহনতি মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিকের ওপর শোষণের অবসান, অনুপার্জিত আয় ভোগ করার সুযোগ বন্ধ, কর্মক্ষম মানুষের জন্য কাজের অধিকার নিশ্চিতকরণ, সকলের জন্য কাজের গুণ ও পরিমাণ অনুযায়ী পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, সাম্যের সমাজ নির্মাণের লক্ষ্য– এসব কথা স্পষ্টভাবে সংবিধানে লেখা আছে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-সামাজিক দর্শন কী হবে সে সম্পর্কে সংবিধানে অস্পষ্টতা রাখা হয়নি। এগুলোই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক নীতি ও লক্ষ্যের মর্মকথা। বাজেটের সারবত্তার প্রকৃত পরিমাপের আসল জায়গাটি হলো জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে তা কী প্রভাব সৃষ্টি করে– সেটি। সরকারের যেমন আয়-ব্যয় থাকে, প্রত্যেক পরিবারেরও (এবং ব্যক্তির) তেমন আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব আছে। সেই অনুসারেই তাকে সংসারের কাজকর্ম চালাতে হয়। সব পরিবারের সে ধরনের একটা বাজেট থাকার কথা। কিন্তু দেশের অধিকাংশ পরিবারের পক্ষে বাৎসরিক বাজেট করে চলার উপায় নেই। তাদের অধিকাংশেরই অনিশ্চিত ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। অনেকের অবস্থা আরো খারাপ। দেশের ৯৯ শতাংশ গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের আয় টাকার অংকে যে বাড়ে নাই, তা নয়। দেশের মোট সম্পদ এবং সেই সাথে বাজেট যে পরিমাণে বেড়েছে তার চুঁইয়ে পড়া ছিটে-ফোঁটা তাদের কাছেও এসেছে। তবে, সেই পরিমাণ যৎসামান্য। তাছাড়া ‘আয়’ যৎসামান্য বাড়লেও তাদের ‘প্রকৃত আয়’ বেড়েছে যৎসামান্য থেকেও আরো কম। কারণ, আয় যতটুকু বেড়েছে তার একটি প্রধান অংশ মূল্যস্ফীতির চাপে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়, সাধারণ গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে তাদের নগণ্য প্রাপ্তিটুকুও অর্থহীন হয়ে থাকছে। বাজেটে বিশাল ঘাটতি থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে ব্যাংকসহ বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে। ইতোমধ্যে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৫ শতাংশ এবং ১৭-১৮ কোটি মানুষের প্রত্যেকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৬৭ হাজার টাকা। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে খোদ সরকারই যদি এভাবে বড় ঋণগ্রহীতা হয়ে ওঠে তাহলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হবে, বিনিয়োগের জন্য ব্যক্তি ঋণের পরিমাণ কমে যাবে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী হবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অর্থমন্ত্রী ঘাটতি মেটাতে এদিক-ওদিক থেকে ঋণ নিয়ে দেশের আর্থিক খাতে ধস নামানোর মতো বিপদজনক জুয়াখেলায় লিপ্ত হয়ে হয়তো জমা-খরচের হিসাব মিলিয়ে দেবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের সংসারের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি মেটাবেন কিভাবে, তার ফর্মুলা অর্থমন্ত্রীর কাছে নেই। এটি থাকার প্রয়োজনও তার নেই। কারণ বাজেট তো জনগণের জন্য নয়! পর্যায়ক্রমিক সব সরকারের আমলেই বাজেট প্রণীত হয়ে থাকে দেশি-বিদেশি লুটেরা ধনিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য। তাদের স্বার্থের রক্ষক হয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারাই সব সরকারের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। সে কারণে জনগণের সংসারের বাজেট যদি নিরন্তর ঘাটতির অন্ধকারে ডুবে থাকে, এ ধরনের সরকারের তাতে কি-ই বা যায় আসে!

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..