কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের বন্ধু:কমরেড মোর্শেদ আলী
রুনু আলী
মফস্বলের এক ডানপিটে কিশোর, পাড়াজুড়ে দাপিয়ে বেড়াতেন, পুকুরে সাঁতার কাটতেন, মাঠে ফুটবল খেলতেন, শৈশব ছিল যার আনন্দে ভরপুর, তিনি আর কেউ নন বাবা-মার আদরের মোর্শেদ আলী। মা সোহাগ করে ডাকতেন ‘চানু’। যদিও তিনি আমার সহোদর ভাই, তবুও আমার মতো একজন ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে কমরেড মোর্শেদ আলী-কে নিয়ে কিছু লেখা খুবই কষ্টসাধ্য। একই মতাদর্শের কারণে প্রায়ই তাঁর সাথে কথা হতো, মতবিনিময় হতো। তাই আজ যা কিছু বিবৃত করার চেষ্টা করছি তা তাঁর লিখে যাওয়া বয়ান থেকেই নেয়া।
১৯৪৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার গোপালপুরে তাঁর জন্ম। আমাদের বাবা শেখ আরশেদ আলী মাস্টার ও মাতা সালমা খানম। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, মা গৃহীনি। আমাদের সাত ভাই বোনের মধ্যে মোর্শেদ ভাই দ্বিতীয়। তাই আমি তাঁকে ‘মেজো ভাই’ বলে ডাকতাম। যদিও তাঁর জন্ম হয় গোপালপুরে, কিন্তু তাঁর শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের বেড়ে উঠা ঈশ্বরদী স্কুল পাড়াতে। আমাদের নানা বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে, আর দাদার বাড়ি বর্তমান কান্দি সাবডিভিশনের রহিগ্রামে। প্রথম জীবনে বাবা সরকারি চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে তিনি পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে বদলী হয়ে আসেন এবং সেই থেকে ঈশ্বরদীতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর বাবা সরকারি চাকরিতে অপশন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান।
ছোটবেলা থেকে মেজো ভাই মোর্শেদ আলী খুব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন বলে মায়ের কাছে শুনেছি। তবে লেখাপড়ায় খুব ভাল হওয়ার কারণে সবকিছুতে মাফ পেয়ে যেতেন। কমরেড মোর্শেদ আলী ঈশ্বরদী সাঁড়া মাড়োয়াড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। স্কুল জীবনে তিনি খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার সাথে জড়িত ছিলেন। স্কুলে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তিনি সব সময় প্রথম হতেন। এই বিদ্যালয় থেকেই তিনি ১৯৬০ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর প্রথমে রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু হোস্টেলে সিট না পাওয়ায় ঈশ্বরদী থেকে যাতায়াত করতে হতো। যা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য, সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। তাঁর এই অসুবিধার কথা জানতে পারেন প্রতিবেশী এক ভাই অধ্যাপক আব্দুল জলিল। তিনি তখন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান। জলিল স্যার মোর্শেদ আলীর কৃতিত্বের কথা জানতেন এবং বাবার অনুমতি সাপেক্ষে মোর্শেদ আলীকে নিয়ে নিজ তত্ত্বাবধানে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি করে দেন।
মোর্শেদ আলী ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আইএসসি পাস করে ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসিতে ভর্তি হন এবং পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা হলের ছাত্র ছিলেন (বর্তমানে ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ হল)। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই তিনি ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং ঐ বছর হল সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্র লীগ ও এনএসএফের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ঢাকা হলের এজিএস নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালের শেষের দিকে ডাকসুসহ হল সংসদ নির্বাচন হয়। ঐ সময় বর্তমান নরসিংদী জেলায় এক কৃষক মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে মোর্শেদ আলীসহ আরো কয়েকজন নেতাকর্মীকে আইউব শাহীর পুলিশ বাহিনী গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ঢাকা হলের জিএস মজিবুল হকও ছিলেন। পরবর্তীতে তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে জেলে থাকা অবস্থায়ই মোর্শেদ আলী ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু দেওয়ানী নামক এক সেলে থাকতেন। কয়েকদিন পর মোর্শেদ আলী ও মজিবুল হককে ঐ সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সাথে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় এক বছর ছিলেন। এ সময় তাঁদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ব্যাপক ছাত্র-গণ আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তাদের দুজনকে তৎকালীন সামরিজ জান্তা সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সে সময়ের ডাকসুর ভিপি মাহফুজা খানমের অবিরাম চেষ্টা তাদের মুক্ত করতে সহায়তা করেছিল।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত মোর্শেদ আলী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ইতোমধ্যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন এবং পার্টির সিদ্ধান্তেই পরবর্তীতে তারা ক’জন মিলে ন্যাপে (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) যোগ দেন। কিন্তু বেসিক কাজ হিসেবে ট্রেড ইউনিয়ন অন্দোলনে যোগ দেন। প্রথমে হাজারীবাগ ট্যানারি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে পয়লা বৈশাখে ডেমরা এলাকায় এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। বহু ঘরবাড়ি, কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বহু মানুষের মৃত্যু হয়। বালু নদীতে মানুষের শত শত লাশ ভাসতে থাকে। পার্টির তরফ থেকে নির্দেশ এলো ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় মানুষের সেবায় নেমে পড়ার। প্রায় দুই মাস ডেমরা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান করে রিলিফ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেই সুবাদে গ্রামের মানুষগুলোর সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। সম্পর্ক গড়ে উঠে লতিফ বাওয়ানী জুট ও টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের সাথে। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে লতিফ বাওয়ানি জুট মিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সাইফুদ্দিন আহমেদ মাণিক ও সহিদুল্লাহ চৌধুরীর প্যানেল বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। সাইফুদ্দিন আহমেদ মাণিক সভাপতি, মোর্শেদ আলী সহসভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মালিক পক্ষ তাদের প্যানেল জিততে না পারার কারণে মাণিক-সহিদুল্লাহ প্যানেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের মুখে ১৯৭০ সালে মালিক পক্ষ মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৭১ এর ৭ মার্চ মোর্শেদ আলী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ডেমরা থেকে পায়ে হেঁটে মিছিল সহকারে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগ দেন। দেশ দ্রুত স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে গেলে পার্টির পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি পশ্চিমবঙ্গের আগরতলায় চলে যান। সেখানে ক্যাম্প ক্রাফ্ট হোস্টেলে উঠেন। কিছুদিন থাকার পর ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে আসামের তেজপুরে গেরিলা ট্রেনিং নিতে যান। ট্রেনিং শেষে গেরিলা বাহিনীর একটি দলের নেতা হিসেবে দেশে প্রবেশ করেন। ৯ মাসের যুদ্ধে তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর মোর্শেদ আলী তাঁর দল নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রয়াত কবি সুফিয়া কামাল এবং ন্যাপ নেতা গোলাম মহিউদ্দিন তাঁদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
এরপর পার্টির নির্দেশে যার যেখানে কাজ সে সেখানে কাজে যোগ দেন। প্রধান কর্তব্য যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা। তিনি ডেমরায় গিয়ে যুদ্ধ বিধস্ত লতিফ বাওয়ানী মিলকে চালু করার জন্য শ্রমিকদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বোমায় বিধস্ত বাওয়ানী জুট মিলে উৎপাদন শুরু হয়। তখনকার সংকটের মুহূর্তে একমাত্র তাঁর মুখের কথায় ব্যবসায়ীরা মিলে পাট সরবরাহ করতে রাজী হয়েছিলেন। কমরেড মোর্শেদ আলী ডেমরা শিল্পাঞ্চলের গণমানুষের সাথে এমনভাবে মিশে গিয়েছিলেন যে, এলাকার মানুষ তাঁকে ডেমরার মৌলভী বলে ডাকত। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে আবার তাঁকে আত্মগোপন করে কাজ করতে হয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
১৯৮০ সলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে মোর্শেদ আলী কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। চতুর্থ কংগ্রেসে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য ছিলেন।
ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনে অভিজ্ঞতা তার যৌবনেই হয়েছিল। কৃষকদের দুরাবস্থা দূর করার জন্য তিনি পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলন যুক্ত হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ কৃষক সমিতির প্রথমে সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমরেড মোর্শেদ আলী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে গেছেন।
১৯৭৬ সাল, সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। পার্টির কার্যক্রম চলছে গোপনে। সে সময়ে মোর্শেদ ভাইয়ের উপরে পুলিশের নজরদারি ছিল। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে ১৯৭৬ সালের ১১ এপ্রিল তিনি আফতাবুন্নাহার শেলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ঢাকার কলাবাগানের বাসিন্দা পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী এবং মোর্শেদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠজন আশরাফ হোসেন আশুর বাসায় ঘরোয়া পরিবেশে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ আসতো। সেই সুবাদে মোর্শেদ আলী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরি এবং পূর্ব জার্মানী সফর করেন। সেই সুযোগে ১৯৭৪ সালে প্রথম মহাকাশচারী নারী ভ্যালেনতিনা তেরেশকোভার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ১৯৯৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি দিল্লী যাওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
সুযোগ ছিল তাঁর সমাজের উঁচুতলায় পৌঁছে সেখানকার সকল সুবিধা ভোগ করার। সুযোগ ছিল বিত্ত-বৈভবে সমৃদ্ধশালী হবার, বিত্তবান-ক্ষমতাবান হবার। কিন্তু না, তিনি তার কিছুই করলেন না। কোনো লালসাই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। সব সুযোগ-সুবিধাকে পদদলিত করে বেছে নিয়েছিলেন মেহনতি মানুষের জন্য সংগ্রামের জীবন। লক্ষ্য একটাই, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের আর্থ সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে বৈষম্যহীন এক মানবিক সমাজ বিনির্মাণের।
জয়তু কমরেড মোর্শেদ আলী।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটি ও
কমরেড মোর্শেদ আলীর কনিষ্ঠ সহোদর
Login to comment..