পুরানো সংখ্যা থেকে

পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে

[সাপ্তাহিক একতার সংগ্রহে থাকা ১৯৭২ সালে ২ জুনের সংখ্যা থেকে]

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

রাজনৈতিক ভাষ্যকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক গগনে আবার দুর্যোগের ঘনঘটা শুরু হচ্ছে কিনা—এ প্রশ্ন আজ সকলের অন্তরে জাগরিত হয়েছে। অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। একটা অনিশ্চয়তার আশঙ্কা বিরাজ করছে। সরকারি দলে একটা ভাঙনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়াতেই জনগণ গুজবের কিছু ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছেন। সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো থেকে অনেক বিবৃতি পাল্টা বিবৃতি প্রচারিত হয়েছে। ইতিমধ্যে গণজীবনের সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থ ও খাদ্য সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের দুয়ারে হাজির হয়েছে। উগ্র বামপন্থিদের বিরুদ্ধে সরকার কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের পথ করেছেন। জাতীয়করণকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হ্রাসকরণের চক্রান্ত প্রতিরোধের জন্য সরকার ছয় মাসের জন্য শ্রমিকদের ধর্মঘট ও ঘেরাও করার অধিকার কেড়ে নিয়ে অর্ডিন্যাস জারি করেছেন। ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নসমূহের নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অনুসাারী ঐতিহ্যশালী ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ দু’টি সুস্পষ্ট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। দু’গ্রুপের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই ভাঙন নেহায়েত নেতৃত্বের কোন্দল নয়। এর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রশ্ন। রব-গ্রুপের নেতারা যা বলতে চায় তার সার কথা হল বর্তমান সরকার বাংলাদেশের উঠতি পুঁজিপতিদের সরকার। বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই সরকার তথা পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ‘শ্রেণি সংগ্রাম’ এবং ‘সামাজিক বিপ্লবের’ মাধ্যমেই তা করতে হবে। তাঁরা আরও মনে করেন যে, বাংলাদেশের উঠতি পুঁজিপতিদের ভারতের বুর্জোয়া সরকার সাহায্য করছে তাই ভারতের বিরোধিতা করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাঁরা ভারতের সহযোগী মিত্রদেশ মনে কর। সে কারণে তারা বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী দৃঢ়করণের পক্ষে নয়, বরং বলা চলে বিরুদ্ধেই। অপরপক্ষে মুজিববাদের সমর্থক বলে দাবি করে যারা-নূরে আলম সিদ্দিকী গ্রুপ তারা সোভিয়েত-চীন মার্কা বিদেশি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নয় বলে ঘোষণা করেছে এবং জাতীয়তাবাদকে তাদের ‘সমাজতন্ত্রের’ ভিত্তি হিসেবে ধরে রাখতে চায়। তাদের মতে মার্কসবাদকে সংশোধন করে রাশিয়ায় ‘লেনিনবাদ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, চীন দেশে ‘মাওবাদ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে– সেভাবেই আজ বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্যের ভিত্তিতে ‘মুজিববাদ’ প্রতিষ্ঠা করা দরকার এবং মুজিববাদের রয়েছে চারটি স্তম্ভ– “জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র”। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের ফলাফল হল এই যে, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন একক এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ছাত্রলীগের ‘মুজিববাদী’ অংশ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাত্রলীগের মধ্যে তুলনামূলকভাবে ‘রব-গ্রুপ’ অনেক বেশি ভাল ফল কররে। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে। কারণ ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগের তরুণ নেতার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর শক্তির অন্যতম কেন্দ্র। আর বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের প্রাধান্যের বিষয়কে নতুন করে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই– সে কথা আমাদের জানাই আছে। তাই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জনসম্মুখে প্রকাশ্যে রব-গ্রুপকে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে রব-গ্রুপ আওয়ামী লীগ সরকার ও আওয়ামী লীগ এমসিএ-দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে, মন্ত্রিসভা বাতিল করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সকল রাজনৈতিক দল ও গণপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমবায়ে একটি ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের দাবি তোলে। আওয়ামী লীগের অনুসারী জাতীয় শ্রমিক লীগ রব-গ্রুপের উত্থাপিত দাবি সমর্থন করে। এরবং নিজেরাও অনুরূপ দাবি উত্থাপন করে। সাধারণভাবে এই ধারণা সকলের মধ্যে বিরাজমান যে, জাতীয় শ্রমিক লীগের মধ্যে কোন বিভেদ নেই এবং গোটা সংগঠনই বঙ্গবন্ধুর সরকারের সমর্থক। বিশেষত মাত্র অল্প কয়েক দিন পূর্বে জাতীয় শ্রমিক লীগের জাতীয় সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে এবং নেতৃত্ব নিয়ে প্রকাশ্য কোন কোন্দল সৃষ্টি হয়নি। তাই জাতীয় শ্রমিক লীগ ছাত্রলীগের রব-গ্রুপের সরকার বদল ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা দাবি সমর্থন করায় জনমনে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় যে, বঙ্গবন্ধু স্বয়ং গণপরিষদ বাতিল, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও সরকার বদলের কথা চিন্তা করছেন কিনা? জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের আওয়াজ অগণতান্ত্রিক ও বিভেদমূলক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ১ জুন নিম্নোক্ত বিবৃতি দিয়েছেন : “ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের একটা অংশ দেশে ‘জরুরি অবস্থা’ ও ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের দাবি করিয়া যে বিবৃতি দিয়াছেন, তাহা দেখিয়া আমরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়াছি। ইহা আজ অনস্বীকার্য যে, আমাদের স্বাধীনতাকে বিপর্যস্ত করার জন্য দেশি ও বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের গভীর ষড়যন্ত্র চলিতেছে, দেশে একটা গভীর খাদ্য সংকট ও অর্থনৈতিক সংকট চলিতেছে, দেশে ব্যাপক দুর্নীতি চলিতেছে এবং এক শ্রেণির এম, সি, এও এই দুর্নীতির সহিত জড়িত রহিয়াছেন। উপরোক্ত সমস্ত সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য সরকার ও দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল দলসমূহের ও জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকারের যে জনসমর্থন ও ক্ষমতা রহিয়াছে তাহাতে সরকার দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর সহায়তা নিয়া ঐ সকল সমস্যার মোকাবিলা করতে পারেনি। ইহার জন্য ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করার বা তথাকথিত ‘বিপ্লবী সরকারের’ নামে ডিকক্টেটরি শাসন কায়েম করার কোন প্রয়োজন পড়ে না। বরং জরুরি অবস্থা ঘোষিত হওয়ার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হইলে জনগণের মনে অনিশ্চিত অবস্থা দেখা দিবে এবং বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণারই সৃষ্টি হইবে। এইরূপ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশের অগ্রগতির পথে মারাত্মক ক্ষতিকর হইবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি তাহাছাড়া, সরকার আজ ব্যাংক, শিল্প-প্রভৃতি জাতীয়করণ এবং ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে কতকগুলি প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছেন। এইসব পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়িত করা, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন অন্তত যুদ্ধ পূর্ব অবস্থায় ফিরাইয়া আনা, দুর্নীতি দূরীকরণ এবং দেশের সর্বত্র শান্তি শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি কাজ হইল সকল দেশপ্রেমিকদের আশু কর্তব্য। ইহার জন্য সর্বোপরি প্রয়োজন হইল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী অবিলম্বে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনা করা এবং সে শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে যথাসম্ভব শীঘ্র নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করিয়া দেশে একটা স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দ্বারা গণপরিষদ ভাঙ্গিয়া দিয়া তথাকথিত ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের দাবি গৃহীত হইলে সরকাররের সমস্ত প্রগতিশীল কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে দারুণ বিঘ্ন সৃষ্টি হইবে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ ব্যর্থ হইয়া যাইবে, দেশে এক মারাত্মক অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হইবে এবং দেশের ভিতর অনৈক্য দেখা দিবে। ইহাতে লাভবান হইবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদী চীনা ও দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা, যারা আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিপর্যস্ত করিতে চায়। তাই, ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’ ও ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের দাবিকে আমরা বিভেদমূলক, অগণতান্ত্রিক ও দেশের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর বলিয়া মনে করি। এইরূপ দাবিকে অগ্রাহ্য করার জন্য আমরা সরকার ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।” [এই সংখ্যায় প্রকাশিত অপর আরেকটি সংবাদ] রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে ধর্মঘট নিষিদ্ধ আদেশ প্রত্যাহার কর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী ৩০ মে নিম্নোক্ত বিবৃতি দিয়েছেন : বাংলাদেশ সরকার জাতীয়করণকৃত শিল্পসমূহে ৬ মাসের জন্য ধর্মঘট নিষিদ্ধ করিয়া একটি জরুরি আদেশ জারি করিয়াছেন। বিআইডিসি’র কতিপয় প্রতিষ্ঠান ধর্মঘটের নোটিশ প্রদান ও তজ্জন্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কায় সরকার এই আদেশ জারি করিয়াছেন বলিয়া প্রকাশ। কিন্তু সরকারের এই পদক্ষেপ তাহাদের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যকেই ব্যাহত করিবে। ধর্মঘটের অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক শ্রেণির একটি মৌলিক অধিকার। ধর্মঘটের অধিকার দমন করিলে তাহাদের মধ্যে যে নিরুৎসাহ ও বিক্ষোভের ভাব সৃষ্টি করিবে তাহাতে শিল্প জাতীয়করণের নীতি কার্যকরী হইতে পারে না। আমরা সরকারের নিকট এই অনুরোধ জানাইতেছি যেন তাঁহারা অবিলম্বে উক্ত আদেশ প্রত্যাহার করিয়া নেন এবং জাতীয়করণ নীতিতে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনসমূহের সহায়তায় শ্রমিকদিগকে উৎপাদনের কাজে উৎসাহিত করেন। আমরা মনে করি, বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের পক্ষে ধর্মঘটের আশ্রয় গ্রহণ না করিয়া অন্য পন্থায় তাহাদের সমস্যাবলীর সমাধান করা দরকার।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..